মাদুরো সামাল দিতে পারবেন?

নিকোলাস মাদুরো
নিকোলাস মাদুরো

যেসব দেশের নেতা পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাহ্য করে টিকেছিলেন, ভেনেজুয়েলার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজ তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের’ বিরুদ্ধে চাভেজ ছিলেন সব সময়ই উচ্চকিত। চাভেজ ক্ষমতায় আসেন ১৯৯৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে। তাঁর কৃতিত্ব হলো ‘জিনি সূচক’-এর আয় বণ্টন অনুযায়ী ভেনেজুয়েলাকে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে সমতাভিত্তিক দেশে পরিণত করা। দারিদ্র্য অনেক কমে আসে, নিরক্ষরতা দূরীভূত হয় উল্লেখযোগ্য হারে এবং রাষ্ট্রীয় খরচে গরিবদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিনা মূল্যে সবার স্বাস্থ্যসেবাও দেওয়া হয়।
চাভেজ বামপন্থী সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলিভ্যারিয়ান বিপ্লব শুরু করেন, যেখানে নিচ থেকে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ওপর থেকে পথ তৈরি করে দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বলিভারের নাম অনুকরণ করে চাভেজের বিপ্লব বলিভ্যারিয়ান বিপ্লব নাম দেওয়া সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ারই রূপক প্রচেষ্টা।
চাভেজের মৃত্যুর পর গত ১৪ এপ্রিলের নির্বাচনে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তাঁরই আদর্শপুষ্ট নিকোলাস মাদুরো। মাদুরোর সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক। ২ শতাংশেরও কম ভোটের ব্যবধানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মেয়র নির্বাচন ভেনেজুয়েলার মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন নির্দেশ করে। চাভেজের ক্যারিশমা মাদুরোর মধ্যে না থাকায় দলকে একীভূত রাখার চ্যালেঞ্জও তাঁকে নিতে হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক নেতা, সেনাবাহিনী ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর মধ্যে স্বার্থ এবং বিভাজনকে মোকাবিলা করার মতো ক্যারিশমা পূর্বসূরির মতো মাদুরোর মধ্যে নেই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রায় পাঁচ লাখ চাভিসমো (চাভেজের নীতি) অনুসারী বিরোধী ডেমোক্রেটিক কোয়ালিশনের নেতা ক্যাপ্রিলেসের পক্ষে চলে যায়।
মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। যেখানে ২০১২ সালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, সেখানে গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষক আলবার্টো রামোসের মতে, এ বছর ২ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে এবং সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ পর্যন্ত মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটতে পারে। এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির রেকর্ডটি এখন ভেনেজুয়েলার। এ ছাড়া দুধ, আদা, চিনি, ওষুধ, টয়লেট পেপার ইত্যাদি মৌলিক পণ্যের স্বল্পতাও দেখা দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতাও প্রকট হয়ে পড়েছিল।
৮ ডিসেম্বর দেশটিতে মেয়র নির্বাচন হয়েছে এবং সেখানে মাদুরোর ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টি ও মিত্ররা জয়লাভ করে। এই নির্বাচনকে বলা হচ্ছিল মাদুরোর জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বিরোধী দল ও এর মিত্ররা মিলেও কিন্তু ৪২ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পায়। চাভেজের নেতৃত্বে যে ঐক্য ভেনেজুয়েলায় ছিল, সেটির দ্বিধাবিভক্তি এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চাভেজ মারা যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনীতির করুণ দশা। মাদুরো একজন বাসচালক থেকে আজ দেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সেই পথটি যেমন তাঁর জন্য সহজ ছিল না, তেমনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে অনেক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার মুখোমুখি হওয়ায় কঠিনত্বের পরীক্ষা তাঁকে ভালোভাবেই দিতে হবে।
ভেনেজুয়েলা হয়তো ১৯৭০-৭৩ সালে চিলির সালভাদর আয়েন্দের পপুলার ইউনিটি সরকার যে অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল, তেমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে।
সে সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও স্থানীয় ব্যবসায়ী শ্রেণী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করা এবং অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে অগাস্তো পিনোশের সামরিক স্বৈরাচার কায়েমের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। মধ্য আমেরিকা অঞ্চলে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন টাস্কফোর্স অন দি আমেরিকাসের প্রেসিডেন্ট রজার ডি হ্যারিস মন্তব্য করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বলিভ্যারিয়ান বিপ্লব একটি বড় হুমকি। যুক্তরাষ্ট্র এই বিপ্লবকে ব্যাহত করতে তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে লাখ লাখ ডলার ব্যয় করছে। তাদের ঘোষিত নীতিই হচ্ছে ভেনেজুয়েলায় সরকার পরিবর্তন করা। উদ্দেশ্য হলো শুধু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের অনুকূলে থাকে তেমন কোনো সরকার প্রতিষ্ঠা করা।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে বিরোধীরা কারচুপি হয়েছে দাবি তুলে সহিংসতা চালানোর একটা অনৈতিক কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু সত্যটি ভিন্ন। মাদুরো দুই লাখ ৬০ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হলেও যুক্তরাষ্ট্র স্বচ্ছ নির্বাচন বলে মানতে চাইছে না। কিন্তু জন এফ কেনেডি ১৯৬০ সালে ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হন, যেখানে পরাজিত প্রার্থী রিচার্ড নিক্সন পান ৪৯ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট। এ ছাড়া ২০০০ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশ ৪৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হলেও প্রতিদ্বন্দ্বী আল গোর ৪৮ দশমিক ৩৮ শতাংশ পপুলার ভোট পেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এ বিষয়ে মার্কিন অধ্যাপক ড্যানিয়েল কোভালিক বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সহিংসতার মাধ্যমে হলেও তারা ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করতে চায়।
দেখার বিষয় হলো, মাদুরো কত দিন এসব সামলাতে পারেন। জর্জ সিসেরিয়েলো মাহের তাঁর গ্রন্থ উই ক্রিয়েটেড চাভেজ: আ পিপলস হিস্ট্রি অব দ্য ভেনেজুয়েলান রেভল্যুশন-এ বলেন, ভেনেজুয়েলার বিপ্লব মানেই চাভেজ নন। তিনি ত্রিনিদাদের তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ সিএলআর জেমসকে অনুকরণ করে বলেন, চাভেজ বিপ্লব তৈরি করেননি, বিপ্লবই চাভেজকে তৈরি করেছে। এটি সব সমাজের ক্ষেত্রেই সমান সত্য। বিপ্লবী মরে গেলেই তো আর বিপ্লবী চেতনা মরে যেতে পারে না। সাফল্য নির্ভর করে পরবর্তী নেতৃত্ব কীভাবে সেটা চালিয়ে নেবেন, তার ওপর।

খলিলউল্লাহ্: সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।
[email protected]