মারি বিজয়ের কেতন উড়াও শূন্যে

বাংলাদেশের মানুষ দারিদ্র্য আর ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করেছে এক ইতিহাসের লম্বা সময়জুড়ে। এই দু-তিন দশক ধরে সেই যুদ্ধের তীব্রতা অনেকটাই কমেছিল, যদিও সবার জন্য নয়। কিন্তু সময়টা ভালো হোক, খারাপ হোক, মানুষ উদ্‌যাপনের উপলক্ষগুলো এড়িয়ে যায়নি। ঈদে মানুষ আনন্দ করেছে, যতটুকু সাধ্য পরিবারকে স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে। পূজা–পার্বণেও। নববর্ষে এবং নতুন ফসল ঘরে তোলার সময়েও। শুধু একাত্তরে এই উদ্‌যাপনে বিরতি পড়েছে।

কিন্তু যুদ্ধজয়ের কেতন একদিন শূন্যে উড়বে—মানুষ এই আশায় এই ব্যতিক্রমটি মেনেও নিয়েছে। যুদ্ধজয়ের পর মানুষ জীবন গড়ার কাজে নেমেছে, সারা বছরের উদ্‌যাপনগুলো যাতে নিরবচ্ছিন্ন হয়, আনন্দের হয়, সেই চেষ্টা করেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক হানাহানি এবং পুঁজির শোষণ মাঝেমধ্যে সেই আনন্দ ম্লান করেছে, কিন্তু মানুষ সেগুলোকে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেয়নি। উদ্‌যাপনের আনন্দ প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তারা এগোচ্ছিল, কিন্তু এরপর যে বিপর্যয় সামনে এসে দাঁড়াল, তার জন্য কেউ কি প্রস্তুত ছিল? কে ভাবতে পেরেছিল উৎসবের এবং উদ্‌যাপনের যে প্রধান শর্ত হাতে হাত রাখা, প্রাণে প্রাণ মেলানো, সেটিই মরণ ডেকে আনতে পারে? কে জানত, এই বিপর্যয় জানিয়ে দেবে, তার থেকে রক্ষা পেতে হলে দরজায় খিল আঁটতে হবে, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে, দেখা হলেও দূর থেকে মুখ ঢেকে, চোখ বাঁচিয়ে কথা বলতে হবে? এই বিপর্যয়, যার নাম অতিমারি, যেটি তৈরি করেছে এক নতুন করোনা জীবাণু, এমনি এক ধাঁধার নাম, যার সমাধান নোবেল-ভূষিত বিজ্ঞানী আর স্বাস্থ্য শাস্ত্রের শিরোমণিদেরও সাধ্যের বাইরে। এমন দুর্যোগে এই বিশ্ব ১০০ বছর আগে একবার পড়েছিল, কিন্তু এবার এর স্থায়িত্ব দীর্ঘতর হবে কি না, এই সন্দেহ প্রবল।

১৪২৭ বঙ্গাব্দের প্রথম দিনে অতিমারিটা শুধু শক্তি সঞ্চয় করছে মাত্র, পুরো শক্তি নিয়ে তখনো ঝাঁপিয়ে পড়েনি। কিন্তু যে ভয়টা সে সৃষ্টি করেছিল মানুষের মনে, তা নববর্ষের আনন্দ ম্লান করে দেওয়ার মতো যথেষ্টই ছিল। তারপরও, অতিমারি থেকে দূরে থাকা গ্রামেগঞ্জের মানুষজন নববর্ষ উদ্‌যাপনের আয়োজন করেছে, সীমিত পরিসরে হলেও; গঞ্জের ব্যবসায়ীরা হালখাতা খুলেছেন; পরিবারের জন্য, অল্প হলেও কেনাকাটা হয়েছে। কিন্তু বৈশাখ তার পরিপূর্ণতা নিয়ে আসেনি, কোথাও যেন শূন্যতা বেজেছে। মানুষ আশায় ছিল, সামনের বছর পুষিয়ে নেওয়া যাবে।

সেই সামনের বছর, অর্থাৎ ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, আজ থেকে শুরু হলো। কিন্তু এবারের বৈশাখ আরও শূন্য। অতিমারির ঝাপটা প্রবল হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে তার আঘাত লেগেছে। এখন প্রতিদিনের একটা হিসাব মানুষের মুখে মুখে ফেরে—কোভিডে কতজন নতুন করে আক্রান্ত হলো, মারা গেল, সংক্রমণ কতটা তীব্র হলো। একদিনের হিসাবকে নিচে ফেলে পরের দিনের হিসাবটা ঊর্ধ্বগামী হয়। শুধু এই শীতল পরিসংখ্যানই নয়; প্রিয়জন, পরিচিতজন, প্রতিবেশীর চলে যাওয়ার ঘটনাগুলো মানুষকে স্তব্ধ করে দেয়। এর সমাপ্তি কবে, কে জানে। মানুষ প্রার্থনা করে, আগামীকালের সূর্যোদয়টা যেন একটা সুসংবাদ নিয়ে আসে।

এই ঘোর দুর্যোগের দিনে সুখবর কম শোনা যায়, কিন্তু কান পেতে রাখলে তা শুনতে দেরি হয় না। আমি দেখেছি মানুষ দাঁড়িয়েছে মানুষের পাশে, হাত মেলে ধরা নাস্তি জেনেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের। তরুণেরা এগিয়ে এসেছে সংকট মোকাবিলায়। আমি জানি উদাহরণগুলো হয়তো যথেষ্ট নয়, কিন্তু সংখ্যা দিয়ে নয়, এগুলোর বিচার করতে হবে এদের পেছনে ঢেলে দেওয়া নিষ্ঠা আর ভালোবাসার নিরিখে। একটা বিশাল নদীর জন্মে প্রবাহটা থাকে সামান্য। এই বৈশাখে আমি প্রবাহটাকে আরও বড় হতে দেখব, আমি নিশ্চিত।

কালবৈশাখীর ধ্বংস তো সৃষ্টিই ডেকে আনে, বৃক্ষের সবুজ তো শূন্যের আকাশেই বিজয়কেতন ওড়ায়। এই নতুন বৈশাখ কি আমাদের একটা বাণী দিচ্ছে না, নববর্ষের মুলতবি রাখা উদ্‌যাপনগুলো আমরা প্রতিদিনই করব, যেদিন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে অতিমারি-ক্লিষ্ট তারুণ্য এগিয়ে যাবে?

আমাদের বিপদে-আপদে, সংকটে-সন্তাপে সান্ত্বনা আর সাহস জোগান রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল। একজনের জন্ম বৈশাখে, আরেকজনের জ্যৈষ্ঠে। গ্রীষ্মের মেজাজটা নজরুলের কবিতাতেই বেশি স্পষ্ট, তিনি বিপ্লবের গান গেয়ে আমাদের জাগান, তাঁর অগ্নিবীণায় অসুন্দরের প্রাণে কাঁপন তোলেন। তবে রবীন্দ্রনাথেও বৈশাখের খরতাপ আছে, আগুন আছে, যে আগুন প্রাণের আবর্জনাকে পোড়ায়। একাত্তরের দুর্যোগে তাঁরা আমাদের পাশে ছিলেন, অতিমারিতেও আছেন। তবে তাঁরা আমাদের যে উজ্জীবনী মন্ত্র দেন, বৈশাখও তা-ই দেয়, বাংলাদেশের জল হাওয়া, প্রকৃতি আর মাটির জীবনও তা-ই দেয়। মন্ত্রটা এ দুজন নতুন সুরে বেঁধেছেন মাত্র, যে সুরটা তাঁদের কাছে দাবি করেছে নতুন সময়, নতুন ইতিহাস। কিন্তু মন্ত্রটি এই মাটির, চিরকালের। এ দুই কবি মৃত্যুতে শোকার্ত হয়েছেন, মানুষের দুঃখে ম্রিয়মাণ হয়েছেন, কিন্তু দুঃখ এবং বিপদ জয়ের অভয়বাণীও শুনিয়েছেন। শান্তিনিকেতনের রুক্ষ প্রকৃতিকে সবুজ দিয়ে ঢেকে দিতে তাঁর ৬৪তম জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথ বৃক্ষরোপণের একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন, যাতে শিক্ষার্থীরা বৃক্ষ বন্দনায় একটি গান গেয়েছিলেন, যে গানে মরুবিজয়ের কেতন ওড়াবার ডাকটি ছিল, ফুলে ফলে পল্লবে মাধুরী ভরিয়ে ধূলিতে প্রাণ আনার আহ্বান ছিল। শূন্যতা আর পূর্ণতা; কঠোরতা আর কোমলতা, মৃত্যু আর মৃত্যুকে অগ্রাহ্য করে জেগে ওঠা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ধরে চলা মৌসুমি এই দ্বৈততার একটি সমাধান রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল চেয়েছেন, যা যাবে মানুষের পক্ষে, প্রাণের পক্ষে, সৃষ্টির পক্ষে।

আমরা যারা একাত্তর দেখেছি, যে বছর মৃত্যুর তালিকাটি প্রতিদিন এত দীর্ঘ হচ্ছিল যে একসময় মনে হতো, এটি অন্তহীনতায় রূপ নেয় কি না; প্রতিদিন এত বীভৎসতা দেখা দিত যে একসময় মনে হতো, অশুভই চিরস্থায়ী কি না; আমাদের কাছে অতিমারির বিপর্যয়ে একাত্তর একটা সান্ত্বনার কথা শোনায়, এই প্রতিটি মৃত্যু, প্রতিটি ক্ষতির ঘটনা হয়তো ভবিষ্যতের অনেক মৃত্যু ঠেকাতে আমাদের শক্তি জোগাবে হয়তো অতিমারি-অন্তে আমরা ভাবতে বসব, এর প্রতিষেধক কি আমরা তৈরি করতে পারি না; যত বঞ্চনার, বৈষম্যের আর অবিচারের ঘটনা এই এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা দেখেছি, সেগুলোর চিরস্থায়ী অবসান ঘটানোর জন্য আমরা সংঘবদ্ধ হতে পারি কি না; স্বাস্থ্যসেবা থেকে যারা বঞ্চিত থাকল, জীবিকা হারিয়ে যারা পথে বসল, পরিবার–প্রধানের তিরোধানে যারা দিশেহারা হলো, তাদের জন্য এমন একটি সুরক্ষা জাল আমরা তৈরি করতে পারি কি না, যা গলিয়ে সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষটিরও পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। কালবৈশাখীর ধ্বংস তো সৃষ্টিই ডেকে আনে, বৃক্ষের সবুজ তো শূন্যের আকাশেই বিজয়কেতন ওড়ায়। এই নতুন বৈশাখ কি আমাদের একটা বাণী দিচ্ছে না, নববর্ষের মুলতবি রাখা উদ্‌যাপনগুলো আমরা প্রতিদিনই করব, যেদিন সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পথে অতিমারি-ক্লিষ্ট তারুণ্য এগিয়ে যাবে?

এখন বিপ্লব অস্ত্রে হওয়ার নজির নেই, কিন্তু নজির আছে চিন্তায়, উদ্ভাবনায়, পরিশ্রমে, সব পরিবর্তন-যোদ্ধার অন্তর্ভুক্তিতে বিপ্লব হওয়ার। বৈশাখ সে রকম এক বিপ্লবের ডাক দিচ্ছে। আমাদের সে জানাচ্ছে, পুরোনোকে পোড়াতে হবে, তাহলে নতুন জাগবে।

আমি একাত্তরে আশাবাদী ছিলাম। তারুণ্য ছিল তার ভিত্তি। এই অতিমারিতেও আমি তা ধরে রেখেছি। আমার আশাবাদের ভিত্তি, এবারও, সেই তারুণ্য।

  • সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ