মালদ্বীপে সামরিক নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকিতে ভারত

১৯৮৮ সালে মালদ্বীপে একটি সশস্ত্র গ্রুপ দেশটির সরকার উৎখাতের চেষ্টা করার পর সেখানে সরকারি বাহিনীকে সহায়তা করতে ভারত একটি প্যারা কমান্ডো পাঠিয়েছিল। মালদ্বীপের জনগণ সেই বাহিনীকে সাগ্রহে স্বাগত জানিয়েছিল।

তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইয়ুমকে উৎখাত করতে মালদ্বীপেরই একজন শ্রীলঙ্কাভিত্তিক ব্যবসায়ী তখন সরকারবিরোধী গ্রুপ তৈরি করে অস্ত্রের মুখে ক্ষমতা নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের পাঠানো কমান্ডো ‘অপারেশন ক্যাকটাস’ নামের একটি অভিযান চালিয়ে তাদের অভ্যুত্থানচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়।

আর এখন মালদ্বীপের সেই জনসাধারণ তাঁদের ভূখণ্ডে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে কড়া প্রতিবাদ করছে এবং নিঃশর্তভাবে সেখান থেকে ভারতের সেনা সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছে।

কয়েক দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও রাজপথে ভারতের সেনা সরিয়ে নেওয়ার জোর দাবি উঠেছে। বিক্ষোভকারীরা ভারতীয় সেনাদের মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘#ইন্ডিয়াআউট’ হ্যাশট্যাগ ভাইরাল হয়েছে।

গত ১২ সেপ্টেম্বর প্যাট্রিয়টিক ইয়ুথ মুভমেন্ট নামের একটি সংগঠন মালদ্বীপে ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ মোটরবাইক র‍্যালি করেছে। কয়েক দিন আগে কয়েক শ ছাত্রছাত্রী একই ইস্যুতে সমাবেশ করেছে। সেখান থেকে নারীসহ ৪১ জনকে পুলিশ আটক করেছে।

ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মাদ সোলিহ তাঁর প্রতিপক্ষ আবদুল্লাহ ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমকে গত নির্বাচনে পরাজিত করেন। ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুম চীনপন্থী বলে পরিচিত।

গত কয়েক বছরে সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ দেশটিতে ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়েছে। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বেশ কয়েকবার মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য সরকারকে প্রকাশ্যে চাপ দিয়েছে, এমনকি তারা মালদ্বীপে বসবাসরত ভারতীয়দের সুরক্ষায় সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েন করতেও আহ্বান জানিয়েছে। এর আগে মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ নাশিদ ২০১৮ সালে ভারতকে মালদ্বীপে সেনা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেটিও ভারতবিরোধী মনোভাব উসকে দিয়েছিল।

মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সোলিহ সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি করেছেন। এই চুক্তি অনুযায়ী মালদ্বীপের বেশ কিছু ইস্যুতে ভারতীয় আদালতের রায় মেনে নেওয়ার শর্ত জুড়ে দেওয়া আছে। এটি সাধারণ মালদ্বীপবাসীকে ক্ষুব্ধ করেছে।

যেহেতু ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজের প্রভাব বাড়ানোর জন্য চীন মালদ্বীপের প্রশাসনিক বিষয় নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, সে কারণে ভারত মালদ্বীপে তার সামরিক নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া করতে চায় না। ভারত মালদ্বীপকে তার অবিচ্ছেদ্য মিত্র হিসেবে বহুদিন ধরে দেখে এসেছে। ভারত একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় মালদ্বীপে হেলিকপ্টার ও নজরদারি এয়ারক্রাফট মোতায়েন করেছে।

মালদ্বীপের উপকূলীয় এলাকায় ভারত রাডার ব্যবস্থা স্থাপনে সহায়তা করেছে। মালদ্বীপে ভারতের এসব সামরিক স্থাপনা ও তৎপরতাকে এখন অনেকেই সরাসরি আগ্রাসন হিসেবে দেখছে।

ষাটের দশক থেকে ভারত একটু একটু করে মালদ্বীপে তার সামরিক আধিপত্য বাড়িয়ে এসেছে। সে ক্ষেত্রে কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। ভারত মহাসাগরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চীন ও ভারতের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। এ কারণে মালদ্বীপ উভয় দেশের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

এটা ঠিক যে মালদ্বীপের জনগণের ভারতবিরোধিতা এখনই ভারতকে পিছু হটাতে পারবে না, কিন্তু সোলিহর সরকার করোনাবিধ্বস্ত অর্থনীতির ধাক্কা সামলানোর জন্য চীনের সহায়তা নিতে বাধ্য হতে পারে। এতে মালদ্বীপে চীনের প্রাধান্য আরও বেড়ে যাবে এবং ভারতের আধিপত্য কমে আসবে

মালদ্বীপের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা দেখভালে ভারতের ডোর্নিয়ার এয়ারক্রাফট ব্যবহৃত হবে বলে উভয় দেশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। এ ছাড়া অবৈধ মাছ শিকার ও মাদক চোরাচালান এবং মানব পাচার ঠেকাতে এই এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হবে বলেও জানানো হচ্ছে।

সমালোচকেরা বলছেন, এসব উড়োজাহাজ চালানোর সক্ষমতা মালদ্বীপের পাইলটদের নেই। রাতে এবং খারাপ আবহাওয়ায় এগুলো ওড়ানোর দক্ষতা তাদের না থাকায় ভারতীয় সামরিক পাইলটদেরই তা করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে ভারতের সামরিক শক্তি দেশটিতে মোতায়েন থাকার সুযোগ পাবে।

ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে ছোট–বড় মিলিয়ে এক হাজারের বেশি দ্বীপ আছে। এই দ্বীপগুলোর মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকাভাবে ৮০০ কিলোমিটার নৌপথ আছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশের বেশি জ্বালানি এই পথে যাতায়াত করে। ফলে বেইজিং ও দিল্লি উভয়ের কাছেই মালদ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৬৫ সালে স্বাধীনতার পর থেকেই মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। তখন থেকেই দেশটি চীনের সঙ্গেও যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। তবে সম্প্রতি সেই যোগাযোগ অনেক প্রসারিত হয়েছে। চীন মালদ্বীপে এক দ্বীপের সঙ্গে অন্য দ্বীপের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় বড় বড় সেতুর প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।

এটা ঠিক যে মালদ্বীপের জনগণের ভারতবিরোধিতা এখনই ভারতকে পিছু হটাতে পারবে না, কিন্তু সোলিহর সরকার করোনাবিধ্বস্ত অর্থনীতির ধাক্কা সামলানোর জন্য চীনের সহায়তা নিতে বাধ্য হতে পারে। এতে মালদ্বীপে চীনের প্রাধান্য আরও বেড়ে যাবে এবং ভারতের আধিপত্য কমে আসবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত ও সংক্ষেপিত

সীমা সেনগুপ্ত : কলকাতাভিত্তিক সাংবাদিক ও কলাম লেখক