১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই অর্জন সম্পর্কে বহুল– উচ্চারিত কথা হলো, ‘ত্রিশ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ মা–বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা’। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশির ভাগ রাজনৈতিক বক্তৃতা শুরু হয় এভাবে।
এই কথায় মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান সীমিতভাবে উপস্থাপিত হয়, অন্যদিকে ধর্ষণের ভয়াবহতা ‘ইজ্জত’ শব্দের মধ্য দিয়ে লঘু করা হয়েছে। শুধু এই একটি শব্দ দিয়ে অপরাধের শিকার নারীর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতির মাত্রা বোঝা যায় না। ফলে দীর্ঘ সময়ে এই নারীরা সামাজিকভাবে ‘ইজ্জত’ হারা হয়ে আরও সামাজিক হেনস্তার ভয়ে তাঁদের ওপর করা অন্য নির্যাতনের কথা সামনে তুলে ধরতে পারেননি। কারণ, রাষ্ট্রীয় এই শক্তিশালী প্রতিষ্ঠিত বয়ান পরবর্তী সময়ে নানাভাবে ধর্ষণের শিকার নারীদের বিড়ম্বনাই তৈরি করেছে এবং ‘বীরাঙ্গনা’ মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে কাজ করেছে।
এই ‘ইজ্জত’ হারানোর কথা অন্যকে জানালে বা কোনোভাবে অন্যরা জেনে গেলে নারীর ‘ইজ্জত’ আরেক দফা চলে যাবে—এমন ধারণার দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ–পরবর্তী তিন দশক পর্যন্ত নারীর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও নিপীড়নের ইতিহাসকে আড়ালে রাখা হয়েছে। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের একটি বড় অংশ দীর্ঘদিন আবৃত ছিল। যদিও বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র, যেটি যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের প্রথম থেকেই বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে এবং ১৯৭১ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত প্রথম মুক্তিযুদ্ধের সনদে বীর/বীরাঙ্গনা লিখে রাষ্ট্র এই বীরাঙ্গনাদের মর্যাদা নিশ্চিত করেছিল।
উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বরই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই নারীদের ‘বীরাঙ্গনা’ হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার সিদ্ধান্ত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (মুজিবনগর সরকার) নিলেও, পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীদের জন্য নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও, অনেক নারীকে বাঁচানো যায়নি আত্মহত্যা থেকে। এর পেছনের কারণ ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে না দেখে সামাজিকভাবে ‘ইজ্জতহানি’ হিসেবে দেখা। এই বিষয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, ধর্ষণের মতো অপরাধকে ইজ্জতহানি/শ্লীলতাহানির ঘেরাটোপে আটকে রাখার ফলে বিষয়টা যেন সহনীয়ভাবে হাজির করা হয়। এর মাধ্যমে মানুষের মনে এটির আইনগত ভিত্তির চেয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে হাজির করা হয়।
ফলে স্বাধীন দেশেও ধর্ষণের শিকার নারী ‘লোকলজ্জা’ বা সামাজিক সম্মানের ভয়ে সেটি গোপন রাখছেন। সামাজিক ধারণা হলো, নারীর শরীর ‘নষ্ট’ হয় এবং দূষিত হয়। সেই নারীর শরীর ঘেঁষে ওঠানামা করে পরিবার বা সমাজের ‘ইজ্জত’ বা ‘সম্মান’।
যে অপরাধ করে আইন এবং সমাজের চোখে সে অপরাধী। তারই মানসম্মান যায়। কিন্তু এই ধর্ষণকে ‘ইজ্জতহানি’ হিসেবে দেখার কারণে অপরাধীর মানসম্মান যাওয়ার পরিবর্তে অপরাধের শিকার ব্যক্তির মানসম্মান যায় বলেই মনে করা হয়। দেখা যায়, আসামি সবার সামনে ঘুরে বেড়ালেও অপরাধের শিকার মেয়েটি নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করে।
নারীর প্রতি সহিংসতাকে ঐতিহাসিকভাবে অপরাধ হিসেবে মোকাবিলা না করার খেসারত আমাদের এখনো দিতে হচ্ছে। এখনো ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে না দেখে বেশির ভাগ মিডিয়া শ্লীলতাহানি হিসেবে উপস্থাপন করে। শুধু তা–ই নয়, অনেকেই এই ধর্ষণ শব্দটা খারাপ বলে মুখে উচ্চারণ করতে চান না। কিন্তু এই না চাওয়া কিংবা ধর্ষণের প্রতিশাব্দিক উপস্থাপন (শ্লীলতাহানি, সম্মানহানি) কোনোভাবেই ধর্ষণকে আমাদের মনোজগতে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। সে জন্য বর্তমানে ধর্ষিতা শব্দের ব্যবহার নিয়েও আপত্তি উঠেছে। কারণ, এর মধ্য দিয়েও ধর্ষণ যে একটি অপরাধ, তার স্বীকৃতি মেলে না। তাই ‘ইজ্জতহানি’, ‘শ্লীলতাহানি’, ‘সম্ভ্রমহানি’ বা ‘সম্মানহানি’ তো নয়ই, এমনকি ‘ধর্ষিতা’ শব্দটিও লেখা উচিত নয়। আমাদের লিখতে হবে, বলতে হবে ‘ধর্ষণের শিকার নারী’।
ধর্ষণের এই সামাজিক বোঝাপড়ার জায়গাগুলোর ঐতিহাসিক নির্মাণ থেকেই আমাদের সরে আসতে হবে। এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক যে প্রতিষ্ঠিত বয়ান আছে, সেখান থেকে ইজ্জতের ধারণাকে মুছে ধর্ষণের মতো যুদ্ধাপরাধকেই প্রতিষ্ঠিত করা। আমাদের যে দুই লাখ নারী (যদিও গবেষক সুজান মিলারের হিসাবে আরও অনেক বেশি) ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য হিংস্রতার শিকার হয়েছেন, তাঁদের সেই নিপীড়নের ইতিহাস অগ্রন্থিত রয়ে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সেই নিপীড়নের খুব কম সাক্ষ্যই নিতে পেরেছে। তার কারণ, দীর্ঘ সময় এই বিষয়ে আমাদের নীরবতা, লোকলজ্জা এবং ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের পুরুষতান্ত্রিক দোনোমনা ভাব।
আমাদের বীর নারীদের বেশির ভাগই ইতিমধ্যে মারা গেছেন। তাঁরা সঙ্গে নিয়ে গেছেন সেই মূল্যবান ইতিহাস। একটি দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের নিপীড়নের ইতিহাস সবচেয়ে মূল্যবান। সেই ইতিহাসের বেশির ভাগই আবৃত ‘ইজ্জতের’ ঘোমটায়। আসুন, আমরা সচেতনভাবেই এই বয়ান থেকে সরে আসি।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। zobaidanasreen@gmail.com