মুছে যাওয়া একটি শিক্ষাবর্ষ

প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও উচ্চমাধ্যমিকসহ সমমানের পরীক্ষাগুলো এবার হচ্ছে না।প্রথম আলো

জানুয়ারিতে শিক্ষাবর্ষ শুরু, শেষ হয় ডিসেম্বরে। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, ফলে শিক্ষাবর্ষের আর বাকি মাত্র দুই মাস। শেষ দুই মাসে শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়া সাধারণত হয় না, থাকে পরীক্ষার প্রস্তুতি, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশের ব্যস্ততা।

তার মানে, চলতি শিক্ষাবর্ষ বলে আর কিছুই থাকছে না। আগেই ঘোষণা করা হয়েছে, কেন্দ্রীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা এ বছর অনুষ্ঠিত হবে না। বুধবার ঘোষণা করা হলো, এবারের উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) বা সমমানের পরীক্ষা হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট ও মাধ্যমিক পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করেই এইচএসসি পরীক্ষার মূল্যায়ন হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে ফল চূড়ান্ত করতে হবে। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে মত আছে। তবে করোনাকালে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাস্তবতাও উপেক্ষা করার মতো নয়।

শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া বা শূন্যতা কাটিয়ে ওঠা সত্যিই এক দুরূহ ব্যাপার। সব মিলিয়ে দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর জীবন থেকে এক বছরের মতো হারিয়ে গেল। শিক্ষার্থীদের এমন ক্ষতি এর আগে আর কখনো হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ১৯৭১ সালে শিক্ষার বড় ক্ষতি হয়েছিল, সেটি ছিল জাতির নতুন মানচিত্র পাওয়ার বিরল মুহূর্ত। মুক্তিযুদ্ধে এই ক্ষতির রেশ আরও দুই বছর ছিল। এরপর হরতাল, অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় যে ক্ষতি হয়েছে, তা পরে কাটিয়ে ওঠা গেছে। কিন্তু এভাবে একটি গোটা শিক্ষাবর্ষ হারিয়ে যাওয়ার নজির নেই।

এই পরিস্থিতির মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের জোড়াতালি দিয়ে পার করা হচ্ছে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে সেই সংখ্যাটি অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়ে দেখার মতো। তা ছাড়া সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থ ও অস্তিত্ব জড়িত। কিন্তু সরকারি, সরকারের অনুদানপ্রাপ্ত, নিবন্ধিত বা অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা আর সম্ভব নয়।

এই সময়ের বড় প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার এই ঘাটতি কীভাবে পূরণ হবে। শিক্ষাটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এর মাঝখানে ছেদ পড়লে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীকে ভুগতে হবে। তাই শিক্ষাবর্ষ ডিসেম্বরের বদলে মার্চ পর্যন্ত নেওয়ার আলোচনা আছে। এরপর পর্যায়ক্রমে দুই বছরের মধ্যে ডিসেম্বরে সেশন নামিয়ে আনা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী শিক্ষাবর্ষে ছুটি কমানো যেতে পারে। যেসব প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন, সেখানে এক দিন করা যেতে পারে, কমানো যেতে পারে অন্যান্য কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছুটি।

শুরু থেকে শিক্ষা কর্তৃপক্ষ অনেকগুলো বিকল্প মাথায় নিয়ে এগোচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ে এবং একেকটি বিকল্প আড়ালে চলে যায়। একটি বিকল্প ছিল পাঠ্যক্রম সংক্ষিপ্ত করে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া। কিন্তু শিক্ষাবিদদের অনেকেই এর পক্ষে নয়। শিক্ষাবিদ ছিদ্দিকুর রহমান যেমন মনে করেন, প্রয়োজনে শিক্ষাবর্ষ পিছিয়ে যাক, কিন্তু লার্নিং গ্যাপ কাম্য নয়। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষার্থীকে না পড়িয়ে পরীক্ষা দিতে বসানো যাবে না।

আসলে তাড়াহুড়া করে শিক্ষার্থীদের না পড়িয়ে এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে ওঠানোর ফলটা ভালো হবে না। কারণ, এমন কিছু পাঠ্য থাকে, যেগুলো এক শ্রেণিতে শুরু হয়, ধারাবাহিকভাবে ওপরের শ্রেণিতে গিয়ে শেষ হয়। লেখাপড়ার এই আন্তসম্পর্কটা রক্ষা করা জরুরি।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবার অভিমত হচ্ছে, প্রতিটি শ্রেণির পাঠ্যক্রম করা হয়েছে ওই শ্রেণির নির্ধারিত দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জন করে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। তা কমানো হলে নির্ধারিত জ্ঞান অর্জিত হবে না। এতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। এ ছাড়া তাড়াহুড়া করে পাঠ্যক্রম শেষ করলে শিক্ষার্থীরা ওই জ্ঞান ধারণ করতে পারবে না। তাই তারাও শিক্ষাবর্ষ দুই থেকে তিন মাস বাড়ানোর পক্ষে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদ যেমন আলাপচারিতায় বলছিলেন, শিক্ষাবর্ষ তো একটি প্রশাসনিক বিষয়। তাতে নড়চড় হলে ক্ষতি তেমন একটা হবে না। তবে শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ক্ষতি হতে দেওয়া যাবে না। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে আগের রুটিনে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা নিতে হবে এবং তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে।

দীর্ঘ এই ছুটিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাবর্ষের সময় বৃদ্ধিরও প্রস্তাব করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শিক্ষাবর্ষের সময় বাড়লে ২০২১ সালে ছুটি কমিয়ে শিক্ষাবর্ষের সময় ঠিক রাখা যাবে বলেও মনে করে সংস্থাটি। সে ক্ষেত্রে মার্চ থেকে ২০২১ শিক্ষাবর্ষ শুরু করলে এবং ছুটি কমিয়ে দিলে পরিস্থিতি হয়তো সামাল দেওয়া যাবে।

করোনা পরিস্থিতিতে গত ১৭ মার্চ থেকে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। দীর্ঘ এ ছুটিতে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচারিত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ঘরে বসে শিখি’ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ শিরোনামে ইউটিউব চ্যানেল খুলে ভিডিও ক্লাস আপলোড করা হচ্ছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভার্চ্যুয়াল শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু এই কার্যক্রম সর্বজনীন নয়, এর ভালো-মন্দ, সমস্যা ও সীমাবদ্ধতা আছে।

শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাটাই সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হতে পারে না। বিভিন্ন খাতে আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে সরকারের আগ্রহ যেমন আছে, তেমনি প্রচারও হয়েছে বেশ। কিন্তু শিক্ষার্থীদের ঘরে রাখা ছাড়া তাদের জন্য তেমন কিছু দৃশ্যমান নয়। আমাদের শিক্ষা বিভাগ বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাসটা পর্যন্ত ঠিকমতো চালু করতে পারেনি।

ডিজিটাল বাংলাদেশের সক্ষমতা দেখানোর একটি বড় সময় ছিল এই করোনাকাল। কিন্তু আমরা দেখলাম, দেশের সর্বত্র ইন্টারনেট সংযোগ নেই, যেখানে সংযোগ আছে, তা–ও নেটওয়ার্ক খুব দুর্বল। বিদ্যুতে সয়লাব বলা হলেও গ্রামগঞ্জে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করতেই থাকে। সরকার ছাড়াও শিক্ষায় বেসরকারি বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ চোখে পড়ল না। লেখাপড়ার স্বার্থে ডেটা খরচ কমানোর বিষয়টি কেবল আলোচনা হয়েই থাকল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোগও যথেষ্ট নয়, একধরনের জোড়াতালি দিয়ে চলা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বলব চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর)। এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের সক্ষমতা দেখাতে পারল না, অন্য সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা নাহয় বাদই দিলাম। শেষ পর্যায়ে বুয়েট, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইনে লেখাপড়ায় গতি বাড়িয়েছে, তবে অন্যান্য প্রকৌশল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু সেভাবে এগোতে পারেনি।

শিক্ষার্থী ছাড়াও কোভিড পরিস্থিতিতে দেশের তরুণদের জন্য বড় ধরনের ভোগান্তি অপেক্ষা করছে। প্রত্যেক তরুণের এক বছর পিছিয়ে পড়ার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও জাতীয় ক্ষতি অপূরণীয়। শিক্ষাজীবন শেষ করতে তাঁদের এক বছর বেশি সময় লাগবে, কর্মজীবনেও প্রবেশের সময় পিছিয়ে যাবে। বিসিএস পরীক্ষাসহ প্রায় সব ধরনের নিয়োগ পরীক্ষা স্থবির হয়ে আছে। আবার তরুণদের অনেকেই করোনাকালে চাকরি হারিয়েছে। ছুটিতে আসা, বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রক্রিয়াধীন থাকা এবং করোনাকালে চাকরি হারিয়ে ফিরে আসা শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় চার লাখ, বিপন্ন হয়ে পড়েছে তাঁদের পরিবার। গড়ে প্রতিদিন ফিরে আসছেন দুই হাজার কর্মী।

এ এক চরম চরম অনিশ্চয়তা শ্রম ও চাকরির বাজারে, বিশেষ করে তরুণদের সামনে। বাংলাদেশের চাকরির বাজারে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ লাখ চাকরিপ্রার্থী প্রবেশ করেন৷ তাঁদের মধ্যে ১০-১১ লাখের চাকরির সংস্থান হয়৷ বাকিরা বেকার থাকেন। করোনায় এক বছরের জটে এই সংখ্যাটা প্রায় দ্বিগুণ হবে। চাকরির বাজারে বড় জায়গাটি বেসরকারি খাত, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে এই খাতেরও যথেষ্ট সময় লাগবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখনই খুলুক, সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্য-সুরক্ষা বজায় রাখার পরিবেশ তৈরি করা। এমনিতেই দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভালো নয়। করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচ্ছন্নতা ও স্যানিটেশনের ওপর জোর দিতে হবে। শিক্ষার্থীর শরীরের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাবান, পানির ব্যবস্থা তো লাগবেই। একটি ক্লাস শেষ হওয়ার পর হাত ধোয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনমতো তাদের মাস্ক পরতে আগ্রহী করে তুলতে হবে।

এসব আয়োজনের জন্য বাড়তি কিছু টাকা তো লাগবেই। সেই টাকার অভাব কিন্তু নেই। এবার শিক্ষা খাতে যে উন্নয়ন বরাদ্দ, তার বেশির ভাগই অব্যয়িত থাকবে। সেই টাকার কিছু অংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হোক, এর পাশাপাশি টাকাটা যাতে শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় খরচ হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। করোনাকালে সরকারি নানা বরাদ্দ ও খরচের অভিজ্ঞতা কিন্তু সুখকর নয়। শিশু-কিশোরদের বেলায় যেন এমনটি না ঘটে, সে জন্য স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি করা যেতে পারে। সেই কমিটি হতে পারে স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, শিক্ষা কার্যালয়, বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সমন্বয়ে; এর লক্ষ্য অর্থ ব্যয়ে ভারসাম্য ও স্বচ্ছতা বজায় রাখা।

শরিফুজ্জামান, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

[email protected]