মুরসিকে উৎখাতের এক বছর

মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের সম্প্রতি এক বছর পূর্ণ হলো। এ উপলক্ষে উদ্যাপনের ডাক দিয়েছিলেন অনেকেই, আবার তরুণদের মধ্যে হতাশার সুরও শোনা গেছে। এই তরুণদের অনেকেই আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসিকে সমর্থন করে না।
একটি প্রশ্নের অবতারণা করার মধ্য দিয়ে মিসরে বিভাজনের রাজনীতি ফিরে এসেছে: এই বিদ্রোহ আর কতকাল চলবে? মিসরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরবে কবে? নিরাপত্তা পুনরুদ্ধার হবে কবে?
২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি অভ্যুত্থানের পর মিসরের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে মোহাম্মদ মুরসি শপথ গ্রহণ করেন ২০১২ সালের ৩০ জুন। আর তার এক বছর পরেই সেনাবাহিনীর সমর্থনে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে এসে মুসলিম ব্রাদারহুড ও প্রেসিডেন্ট মুরসির বিদায়ঘণ্টা বাজিয়ে দেন। তারও এক বছর পর ২৫ জানুয়ারি ও ৩০ জুনের অভ্যুত্থানের নেতৃত্বস্থানীয় তরুণদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও বিরোধীদলীয় কর্মী আমর হামজাওয়াই মিসর রাষ্ট্র সম্পর্কে বলেছেন, মিসর ক্রমাগত জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার ক্ষুণ্ন করে চলেছে। দেশটি থেকে ন্যায়বিচার একরকম উঠেই গেছে, আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের প্রবণতাও কমছে না। সেখানে কোনো ভিন্নমতের বালাই নেই, সবাইকে একই রকম মতামত ধারণ করতে হবে—ব্যাপারটা এ পর্যায়েই চলে গেছে। মিসরীয়রা অন্যায় ও নিপীড়নের ভয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছে না। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, জনগণ স্বাধীন আইন প্রণয়নকারী সংস্থা নির্বাচন করতে পারত, সংবিধান সংশোধন করে এ ক্ষমতা রদ করে সংসদে ব্যবসায়ী ও রাষ্ট্রের প্রতি সমব্যথীদের প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি ছাত্ররা এখন আর তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে না এবং শিক্ষকেরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ও ডিন নির্বাচন করতে পারবে না। এদিকে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আলা আল-আসওয়ানি দৈনিক আল মাসরি আল ইউম পত্রিকায় লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। কারণ হিসেবে লেখক বলেছেন, নিজের মতের সঙ্গে না মিললে মিসর চরম নিপীড়নের পথ বেছে নিচ্ছে, সে কারণেই তিনি লেখা বন্ধ করেছেন।
আসওয়ানি তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে বলেছেন, মিসরে এখন শুধু একটি মতামতই গ্রাহ্য করা হয়, ভিন্নমতের কোনো স্থান সেখানে নেই। উল্লিখিত পত্রিকায় তাঁর লেখা বন্ধ করাটা আসলে মিসরে বাকস্বাধীনতা হরণের প্রতীক।তবে এটা কোনো রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ব্যাপার নয়, মনস্তাত্ত্বিক চাপের কারণেই তিনি এটা করেছেন।
এমনকি সংবাদমাধ্যমও নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না, এই সংবাদমাধ্যম তাঁকে নিজের মতামত ব্যক্ত করার কারণে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেছে। এক টেলিভিশন অ্যাংকর তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশি অর্থ গ্রহণের অভিযোগ তুলেছেন। কারণ, তিনি সিসির রাজনীতির প্রতি অনাস্থা ব্যক্ত করেছেন। আসওয়ানির মতে, সংবাদমাধ্যম এ প্রক্রিয়ায় ইউসরি ফৌদাকেও নাজেহাল করবে। এই ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় ভুলচুকের ওপর আলোকপাত করেছেন।
আসওয়ানি বলেন, তিনি ৩০ জুনের বিদ্রোহের একজন অন্যতম সমর্থক, এমনকি অন্যদেরও তিনি এ বিদ্রোহে যোগদানের ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন।‘৩০ জুনের বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে একটি মহান ব্যাপার, সে সময় আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন।কিন্তু তাই বলে আমাকে এ কথা বলা থেকে থামানো যাবে না যে এই সরকার সঠিক পথে নেই, আর সরকারকে বাকস্বাধীনতা ও মতামতের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখাতে হবে—এর বাইরে কেউ নন।’
কোটিপতি নাগিব সোয়ারিসের স্যাটেলাইট টিভিতে ইউসরি ফাওদা কথা বলেছেন। তিনি বলেন, রাষ্ট্র যতই চাপ দিক না কেন, তিনি ফাওদাকে তাঁর টিভিতে কথা বলতে বারণ করবেন না। আর এ রকম চাপে তিনি আগেও পড়েছেন, মোবারকের আমলে ও মিলিটারি কাউন্সিল এবং ব্রাদারহুডের আমলেও তিনি অনুরূপ চাপের মুখে ছিলেন।ব্যঙ্গাত্মক টিভি অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বাসেম ইউসেফ গত মাসে তাঁর বহুল প্রচারিত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার সময় বলেছেন, তিনি আর চাপ নিতে পারছেন না। প্রখ্যাত চিত্রনাট্যকার ও সাংবাদিক বিলাল ফাদলও কলাম লেখা বন্ধ করে দিয়েছেন, অভিযোগ সেই একই—বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ ও এ লক্ষ্যে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
ফাদলের লেখাই শুধু বন্ধ করা হয়নি, রমজানের জন্য তিনি একটি টিভি নাটক লিখেছিলেন, সেটাও বন্ধ করা হয়েছে। এর শিরোনাম হচ্ছে ‘দ্য পিপল অব আলেকসান্দ্রিয়া’। এতে ২৫ জানুয়ারির আগের একজন দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তার জীবন বিধৃত হয়েছে। এর অভিনেতাদের অনেকেই রাষ্ট্রের সমালোচক, যেমন: আমর ওয়াকেদ, বাসামা ও হিশাম সেলিম।
ফাদল এই নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বলেছেন, মোবারক তাঁর ক্ষমতার সবচেয়ে বাড়বাড়ন্ত সময়েও এরূপ নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নিতে সাহস করতেন না। তরুণ রাজনৈতিক কর্মী হোসাম মায়োনেস টুইটারে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, সাংবাদিকতা ও টেলিভিশনের ওপর কবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। তিনি আরও জিজ্ঞাসা করেছেন, তরুণ মিসরীয়দের কত দিন প্রতিবাদ করতে দেওয়া হবে—গত নভেম্বরে একটি নিপীড়নমূলক প্রতিবাদ আইন করা হয়েছে। আর কবে থেকে মতামত ব্যক্ত করার কারণে জেলে পোরা হবে। গত মাসে আল-জাজিরার তিনজন সাংবাদিককে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাঁরা নাকি এমন সংবাদ পরিবেশন করেছেন, যার কারণে মিসরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন² হয়েছে। আর তাঁদের প্রচারিত সংবাদে মুসলিম ব্রাদারহুড নাকি লাভবান হয়েছে। গত বছরের শেষ দিকে এ সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। একই অভিযোগে আরও ১১ জন সাংবাদিককে তাঁদের অনুপস্থিতিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) শেরিফ মনসৌর এই সাজাকে উদ্বেগজনক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
সিপিজে আরও বলেছে, মুরসিকে উৎখাতের পর ৬৫ জনেরও বেশি সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ১৪ জন এখনো আটক। ফলে, মিসর এখন সাংবাদিকদের জন্য বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত ১০টি দেশের একটিতে পরিণত হয়েছে, সেখানে হয়তো আরও অনেক সাংবাদিককে আটক ও হত্যা করা হবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কামাল গাবালা: মিসরের আল-আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক।