মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে রোজার ভূমিকা অপরিসীম। মাহে রমজানে রোজাদার ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে পাপাচার, অশ্লীলতা, মিথ্যাচার, পরচর্চা, পরনিন্দা, ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহসহ সব ধরনের মন্দ কাজ পরিহার করে আত্মশুদ্ধি লাভ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে রোজাদার তাকওয়া অবলম্বন করে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকেন। মুসল্লিরা ঘরে-বাইরে নামাজ ও রোজার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে নতুন পাঞ্জাবি-পাজামা, টুপি কেনেন অথবা ধুয়ে-মুছে পাক-পবিত্র করে রাখেন। দৈনন্দিন জীবনযাত্রার স্বাভাবিক কাজকর্ম সম্পাদন করে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়সহ রমজান মাসের বিশেষ খতমে তারাবি নামাজ জামাতে আদায়ের জন্য মসজিদে ছুটে যান। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত, নফল ইবাদত, জিকর-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-ইস্তেগফার, দান-সাদকা করে তারা বিপদগ্রস্ত অসহায় মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। মুত্তাকিদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত প্রদান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অর্থ-সংকটে দুঃখ-ক্লেশে ও সংগ্রাম-সংকটের সময় ধৈর্যধারণকারী, তারাই হলো সত্যপরায়ণ এবং এরাই মুত্তাকি।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৭৭)
রোজাদার ব্যক্তি রোজা অবস্থায় কখনো মিথ্যা কথা, পাপ কাজ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, জবরদখল, সন্ত্রাস, বোমাবাজি প্রভৃতি সামাজিক অনাচারসহ সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, প্রতারণা, ধূমপান, মাদকদ্রব্য ও জুয়াখেলা—এসব অনৈতিক ও অপকর্মে লিপ্ত হন না। খোদাভীরু লোকের মধ্যে এ সুদৃঢ় বিশ্বাসটুকু জন্মে থাকে যে আমি যা কিছু বলব ও চিন্তাভাবনা করব—এসবই আল্লাহ তাআলা জানেন, শোনেন ও দেখেন। আল্লাহর কাছে ভালো-মন্দ কাজের জবাবদিহি অবশ্যই করতে হবে। রোজা রেখে অগোচরে কোনো কিছু খাওয়া বা কোনো ধরনের বর্জনীয় ও নিষিদ্ধ কাজকর্ম করা যাবে না। কারণ অন্য কেউ না দেখলেও আল্লাহ মানুষের সব কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। এখানেই রোজার সঙ্গে অন্যান্য ইবাদতের পার্থক্য রয়েছে। রোজা অবস্থায় কেউ যদি রোজাদার ব্যক্তিকে গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ, অশুভ ও ক্ষতিকর দুষ্কর্মে প্ররোচিত করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাহলে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা অনুযায়ী তিনি যেন বলে দেন, ‘আমি রোজাদার’।
রোজা এমন একটি গোপন ইবাদত, যাতে রিয়া বা লোক দেখানোর কোনো অবকাশ নেই। রোজাদার ব্যক্তি যদি লোকচক্ষুর অন্তরালে কোনো কিছু পানাহার করেন বা কোনো পাপ কাজে লিপ্ত হন, তাহলে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা বা বোঝা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃত রোজাদার মুত্তাকি ব্যক্তি কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য প্রভৃতি ষড়্রিপু দমনপূর্বক কঠোরভাবে সিয়াম সাধনা করে থাকেন। তাই আল্লাহ তাআলা রোজাদারকে বিশেষভাবে পুরস্কার প্রদান করবেন বলে ঘোষণা করেছেন, ‘রোজা শুধু আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মুসলিম পরিবারে মাহে রমজানের রোজার গুরুত্ব ও অপরিসীম প্রভাব রয়েছে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি—সবাই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। রোজাদার ব্যক্তি পরিবারের ছোট-বড় কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন না, সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন। মাহে রমজানে রোজা রেখে পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে যদি অসদাচরণ করা হয় এবং তাদের প্রতি কটুবাক্য, জুলুম, নির্যাতন, গালিগালাজ করা হয়, তাহলে রোজাদারদের পরিবারে ঝগড়া-বিবাদ, দ্বন্দ্ব-কলহ লেগে থাকতে পারে। এতে পরিবারে যেমন অশান্তি দেখা দিতে পারে, তেমনি আল্লাহ তাআলাও অসন্তুষ্ট হন।
রমজান মাসে পরিবার-পরিজন নিয়ে একসঙ্গে সেহ্রি খাওয়ার পরম আনন্দ রোজার অনন্য বৈশিষ্ট্য। পাড়া-মহল্লায় গভীর রাতে যখন সেহ্রি খাওয়ার জন্য ধর্মপ্রাণ লোকেরা সপরিবারে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন, তখন মুসলমানেরা পরস্পর সমাজের সমমানের রোজাদার গোষ্ঠী বলে ভাবতে সুযোগ পান। ভোরের স্নিগ্ধতার নির্জন পরিবেশে ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের ছোট-বড় সব রোজাদার ব্যক্তির জামাতে নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে যাওয়ার অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় এ রমজানুল মোবারকে। এমনিভাবে সপরিবারে মিলেমিশে বসবাস করে সেহ্রি, ইফতার, তারাবি ও ইবাদত-বন্দেগিতে শরিক হওয়ায় মুসলমানদের পারিবারিক জীবনে অপার শান্তি বিরাজমান থাকে।
মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে রোজার সংযমী মনোভাবের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। পক্ষান্তরে রোজাদার ব্যক্তির অন্যায়-অত্যাচার, জুলুম-নির্যাতন ও অসদাচরণে যদি পরিবারের লোকেরা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন এবং জনজীবনে অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করে, তাহলে কেউ তাকে পছন্দ না করে ঘৃণা করবেন। মাহে রমজান পবিত্র ও পরিশুদ্ধ জীবনযাপনের মাস হলেও অনেকে বিভিন্ন কাজকর্মে, চলাফেরায় সেই পরিশুদ্ধতার শিক্ষা নিতে পারে না, অন্যান্য সময়ের মতো এ মাসেও ঘুষ-দুর্নীতি, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, কর্তব্যে অবহেলা ও শরিয়তগর্হিত অন্যায় কাজে মশগুল থাকে। আল্লাহ তাআলা এহেন তাকওয়াবিহীন দুষ্ট রোজাদার লোকের ওপর খুবই নাখোশ থাকেন। সিয়াম সাধনার সুমহান শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত জীবনবোধ যদি রোজাদারদের জীবনাচরণে প্রতিফলিত হয়, তাহলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত না হয়ে পারে না।
সুতরাং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে মাহে রমজানের রোজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাকওয়া অবলম্বনকারী রোজাদার ব্যক্তি যদি জীবনে কোনো প্রকার অন্যায় ও খারাপ কাজ না করেন, কাউকে ঠকিয়ে বা প্রতারণা করে ক্ষতিগ্রস্ত না করেন, খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল না মেশান, ওজনে কম না দেন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করেন, কারও ক্ষতিসাধন না করেন; বরং সর্বদা ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে পরোপকার করে মাহে রমজানে ত্যাগের অনুপম শিক্ষা ও ইসলামের অনুশাসন মেনে সুন্দর সুশৃঙ্খলভাবে জীবন পরিচালনা করেন, তাহলেই মানবজীবনে ইহলৌকিক শান্তি ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধিত হতে পারে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলাম লেখক।
[email protected]