মোবাইল গেমস খাত কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা দিতে পারে

করোনাকালে মোবাইল গেমসের জনপ্রিয়তা বেড়েছে।
ফাইল ছবি: কবির হোসেন


বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের দেশেও মোবাইল গেমসের বাজারও দিন দিন বড় হচ্ছে। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৭৭ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের এই মোবাইল গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন অ্যাকটিভ প্লেয়ার আছে, যারা নিয়মিত নানা ধরনের মোবাইল গেমস খেলছে। বৈশ্বিক জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ নম্বর এবং এ দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠী কিশোর ও তরুণ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ মার্কেট গেমের বিশ্ববাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মার্কেট। এর ফলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গেমকে বাংলাদেশকেন্দ্রিক মার্কেটিং করতে দেখা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মোবাইল গেমস বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

বেশ কিছু দিক থেকে আন্তর্জাতিক এসব মোবাইল গেম বাংলাদেশে আসা আমাদের জন্য ইতিবাচক। এর মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কর্মসংস্থান, আসছে বিদেশি বিনিয়োগ। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে ভারতের প্রথম সারির মোবাইল গেমস নির্মাতা কোম্পানি মুনফ্রগ ল্যাবস বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে এবং এখানে তাদের অঙ্গসংগঠন উল্কা গেমস লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করে। সম্প্রতি ভারতের মুনফ্রগ ল্যাবস এবং তাদের বাংলাদেশ অঙ্গসংস্থা উল্কা গেমস লিমিটেডের শতভাগ শেয়ার বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার বিনিময়ে অধিগ্রহণ করেছে সুইডেনভিত্তিক মোবাইল গেমস নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান স্টিলফ্রন্ট গ্রুপ। এর মাধ্যমে উল্কা গেমস লিমিটেড বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক মানের মোবাইল গেমিং কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো।

মোবাইল গেমিং ইন্ডাস্ট্রি, যা কিনা বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান একটি শিল্প হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, এমন অধিগ্রহণ বাংলাদেশে এ শিল্পের জন্য একটি অপার সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে বলে এ খাতের বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়েছেন। সরকারও এ খাত থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব পাচ্ছে, যা কিনা যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নিকট ভবিষ্যতে আরও অনেক গুণ বৃদ্ধি পেতে পারে। কয়েক বছর ধরে বিশাল এ বাজার ধরতে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো নিজ উদ্যোগে নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, সম্ভাবনাময় এ বাজারে আমাদের অবদান মাত্র ৫০ থেকে ৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো, যা কিনা ১ শতাংশের অনেক নিচে। এর মূল কারণ হচ্ছে মোবাইল গেমস নিয়ে নানান ধরনের নেতিবাচক ধারণা ও প্রচারণা। অনেকেই এখনো মোবাইল গেমিংকে অনলাইন জুয়া বা অনলাইন বেটিংয়ের সমতুল্য মনে করছেন, যা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা এবং সম্ভাবনাময় এ খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তথ্যপ্রযুক্তির এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা দুরূহ হবে, নিরুৎসাহিত হবে মেধাবী গেম ডেভেলপাররা। অনেক বিদেশি বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।

কিছু তরুণ উদ্যোক্তা নিজ প্রচেষ্টা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গেমিং বাজারে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন। ইতিমধ্যে মুনফ্রগ ল্যাবস ও উল্কা গেমস লিমিটেডের লুডো ক্লাব, তিন পাত্তি গোল্ড, আড্ডা, ক্যারম ইত্যাদি গেম বিশ্বব্যাপী বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্বজুড়ে ১৮ কোটির বেশি ডাউনলোড হয়েছে গেমগুলো। আলফা পটেটো বাংলাদেশের আরেকটি পুরোনো ও স্বনামধন্য গেম স্টুডিও। তারা তাদের প্রকাশক লায়ন স্টুডিওর সঙ্গে মিলে ইতিমধ্যে বেশ কিছু জনপ্রিয় গেম তৈরি করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আই পিল গুড, আইসিং অন দ্য কেক, পন শপ মাস্টার, প্র্যাঙ্ক মাস্টার থ্রিডি। গেমগুলো এরই মধ্যে ১৪ কোটির বেশি ডাউনলোড হয়েছে। আরেকটি সুপরিচিত স্টুডিও হাম্বা গেমস তাদের প্রকাশক টেস্টি পিলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তিনটি জনপ্রিয় গেম প্রকাশ করেছে। পিক মি আপ থ্রিডি, লাইন কালার থ্রিডি ও রোড রইস থ্রিডি সব মিলিয়ে প্রায় ২০ কোটি ডাউনলোড হয়েছে। রাইজ আপ ল্যাবস প্রথম তাদের ট্যাপ ট্যাপ অ্যান্ট গেম দিয়ে পরিচিতি লাভ করে। এরা বর্তমানে ট্রেজার আইল্যান্ড নামক গেম নিয়ে রবির সঙ্গে এবং মিনা নিয়ে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করছে। ফ্রি পিক্সেল গেমস বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো স্টুডিও, যারা ফ্যান্টাসি গেম নিয়ে অনেক দিন ধরে ভালো কাজ করে আসছে। এ ছাড়া নতুনদের মধ্যে থান্ডার গেমস ও প্লেয়েন্স বিদেশি নামকরা প্রকাশক কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে এবং চেষ্টা করে যাচ্ছে নতুন নতুন গেম নিয়ে আসার জন্য।

অনেকেই এখনো মোবাইল গেমিংকে অনলাইন জুয়া বা অনলাইন বেটিংয়ের সমতুল্য মনে করছেন, যা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা এবং সম্ভাবনাময় এ খাতের জন্য হুমকিস্বরূপ। এমন অবস্থা চলতে থাকলে তথ্যপ্রযুক্তির এ খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা দুরূহ হবে, নিরুৎসাহিত হবে মেধাবী গেম ডেভেলপাররা। অনেক বিদেশি বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।

আমাদের দেশে তৈরি গেম থেকেও এখন অনলাইন ও অফলাইন ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে আয় হচ্ছে। মূলত, গেমের অ্যাড, সাবস্ক্রিপশন ও ইন-অ্যাপ পারচেজ থেকে এ আয় হয়ে থাকে। দেশীয় তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো এ আয় থেকে সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স প্রদান করে। উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ অর্থবছরে উল্কা গেমস লিমিটেড বাংলাদেশ সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স বাবদ মোট ৪ দশমিক ৯৮ কোটি টাকা প্রদান করেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা ১০ কোটি ছোঁয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে উল্কা গেমস কর্তৃপক্ষ। এতে প্রতিপাদিত হয় যে কতটা দ্রুত মোবাইল গেমিংয়ের বাজার বড় হচ্ছে। সঠিক পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও অনেক গেমিং স্টুডিও এ খাতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সরকারের রাজস্ব আয়ে অবদান রাখবে। এ ছাড়া যেসব বিদেশি গেম বাংলাদেশের বাইরে থেকে ব্যবসা করছে, তাদের এ দেশে লোকাল অফিস ও ডেভেলপমেন্ট সেন্টার করার জন্য তাগিদ দেওয়া যেতে পারে। তাতে সরকার তার ন্যায্য ভ্যাট-ট্যাক্স পাবে এবং সে সঙ্গে সৃষ্টি হবে নতুন কর্মসংস্থান।

এ বিষয়ে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ বলেন, ‘আইসিটি ডিভিশন থেকে আমরা চার থেকে পাঁচ বছর ধরে মোবাইল অ্যাপস ও গেমসের ওপর বিশেষ নজর দিচ্ছি। সারা দেশে অ্যাপস ও গেমস ডেভেলপমেন্ট, অ্যানিমেশন—এসব দক্ষতা বৃদ্ধিতে দেশব্যাপী ৪২টি অ্যাপ টেস্টিং ও অ্যানিমেশন ল্যাব করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান এ খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা আরও বিস্তারিত ও বিশেষায়িত কাজের উদ্যোগ নিয়েছি। জাতীয় গেমিং পলিসি প্রণয়নসহ বেশ কিছু কার্যক্রম বর্তমানে চলমান রয়েছে।’

পরিশেষে, গেমিং মানেই নেতিবাচক কিছু নয়, টাকা পাচার নয়, গ্যাম্বলিং বা জুয়া নয়। এটি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অতিবর্ধনশীল একটি খাত, যেখানে বাংলাদেশের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সব মহলের সর্বাত্মক সহযোগিতা। ‘অন্যান্য গেমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে’—এমন কথা না বলে ‘বাংলাদেশেরও আন্তর্জাতিক গেমিং মার্কেট থেকে কোটি কোটি টাকা আয়ের সুযোগ রয়েছে’—এমন মন্তব্য বা প্রচারণা তরুণ প্রজন্মের ডেভেলপারদের উৎসাহিত করবে নতুন নতুন গেম নিয়ে চিন্তা করার জন্য, কাজ করার জন্য। সর্বোপরি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল, যেমন: বাংলাদেশ ব্যাংক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী (পুলিশ, র‍্যাব), গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্য রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর ইতিবাচক মনোভাব এবং সহায়ক ভূমিকা বাংলাদেশের মোবাইল বা অনলাইন গেমিং খাতকে ত্বরান্বিত এবং সমৃদ্ধ করতে বিশেষভাবে জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা নিশ্চিত হলে মোবাইল খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সরকারের রাজস্ব আয়ের পথ সুগম হবে।

এ বি এম হামিদুল মিসবাহ ব্যারিস্টার ও ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশনের ন্যাশনাল কনসালট্যান্ট।