ম্যান্ডেলার কাছ থেকে তিন শিক্ষা

নেলসন ম্যান্ডেলা
নেলসন ম্যান্ডেলা

নেলসন ম্যান্ডেলা, সবার প্রিয় মাদিবা, চলে গেলেন। আমাদের জন্য রেখে গেলেন তাঁর সারা জীবনের কীর্তি। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, তাঁর নিজের দেশে তো বটেই, আমাদের দেশেও। শুধু কথার ফুলঝুরি নয়, ম্যান্ডেলার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর সবচেয়ে ভালো পথ হবে তাঁর আদর্শের অনুসরণ। আমরা, বাংলাদেশেও, তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে গোটা কয় শিক্ষা নিতে পারি। আমি সে রকম তিনটি শিক্ষার কথা উল্লেখ করছি।
১. আমি নয়, আমরা: বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে তাঁর দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র ছিলেন ম্যান্ডেলা। পশ্চিমে তো বটেই, তাঁর নিজের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাতেও সেটাই ছিল ম্যান্ডেলার পরিচয়। অথচ ম্যান্ডেলা কখনো নিজেকে আন্দোলনের একমাত্র, এমনকি প্রধান নেতা হিসেবে বিবেচনা করেননি। যখনই নেতৃত্বের কথা উঠেছে, তিনি ‘আমি’ না বলে ‘আমরা’ বলতে ভালোবাসতেন। আত্মজৈবনিক গ্রন্থ লং ওয়াক টু ফ্রিডম-এ ম্যান্ডেলা লিখেছেন, নেতার কাজ পাদপ্রদীপের সব আলো নিজের ওপর ধরে রাখা নয়, পেছনে থেকে সবাইকে সামনে এগোতে সাহায্য করা। ম্যান্ডেলার কথায়, একজন নেতা হলেন মেষপালকের মতো। মেষের দল থাকবে সম্মুখে। যারা সবচেয়ে চতুর ও দ্রুত পথচলায় সক্ষম, মেষপালক তাদের সামনে এগোনোর পথ করে দেবে। অন্যরা তাকেই অনুসরণ করে চলবে, অথচ জানতেও পারবে না পেছন থেকে কে তাদের পরিচালিত করছে।

দলের ভেতরে তাঁর স্থান ভিন্ন—এ কথা জেনেও ম্যান্ডেলা নিজের জন্য অতিরিক্ত মর্যাদা দাবি করেননি। তাঁর আত্মজীবনীর কথা ধরা যাক। গ্রন্থটি তাঁর স্মৃতিকথা হলেও তা নির্মিত হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের মুক্তি আন্দোলনের দলিল হিসাবে। প্রথম খসড়াটি ম্যান্ডেলার, কিন্তু সেই খসড়া পড়ে শোধরানোর দায়িত্ব পড়ে দলের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতা ওয়ালটার সিসুলু, আহমেদ খাতরাদা ও ম্যাক মহারাজের ওপর। বইটির প্রকাশকের দাবি ছিল, ম্যান্ডেলার জীবনের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ যেন তাতে বেশি করে ঢোকানো হয়। ম্যান্ডেলাকে মহান করে দেখানোর চেষ্টা বইটির কাটতি ও ম্যান্ডেলার ব্যক্তিগত ইমেজের জন্য সহায়ক হবে—এই ছিল তাঁর যুক্তি। ম্যান্ডেলা তাঁর সেই কথায় রাজি হননি।

আমাদের দেশের রাজনীতিকেরা, এমনকি তাঁরা যদি পানি গোছেরও কেউ হন, সারাক্ষণ ‘আমি আমি’ করায় ব্যস্ত। প্রধান সারির নেতারা তো বটেই, তাঁদের পুত্র-কন্যারাও দেশের, সরকারের ও দলের তাবৎ সাফল্য নিজেদের ব্যক্তিগত ঝোলায় ফেলতে আগ্রহী। তাঁরা যদি ম্যান্ডেলার কাছ থেকে বিনয় বোধের সামান্য আচরণও শিক্ষা নেন, তাতে কেবল দেশের নয়, তাঁদের নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও অধিক সুরক্ষিত হবে।

২. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সহযোগিতা: ‘তোমার প্রতিপক্ষের সঙ্গে যদি শান্তি চাও, তাহলে তার সঙ্গে একযোগে কাজ করো। দেখবে, সে শত্রু নয়, তোমার সহযোগীতে পরিণত হয়েছে।’ এ কথা ম্যান্ডেলার। শুধু কথা নয়, কাজেও সে কথার প্রমাণ রেখেছেন ম্যান্ডেলা। যাদের হাতে তাঁকে একটানা ২৭ বছর জেল খাটতে হয়েছে, সেই শ্বেতকায় শাসকদের সঙ্গে নিয়ে দেশ গঠনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর সেই চেষ্টায় নিজের দলের নেতা-কর্মীরা সবাই যে খুশি হয়েছিল, তা নয়। ম্যান্ডেলা তাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে সরকার গঠন তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে, কিন্তু দেশ যদি গড়তে হয়, তাহলে শ্বেতকায়দেরও সঙ্গে রাখতে হবে। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সাবেক সরকারপ্রধান ডি ক্লার্ককে তিনি সঙ্গে রেখেছিলেন প্রধান সহকারী হিসেবে। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী জুলু-প্রধান চিফ বুথেলেজিকে, এমনকি তাঁর পথভ্রষ্ট স্ত্রী উইনিকেও নিজের মন্ত্রিসভায় স্থান দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ গ্রহণের দিন শ্বেতকায়দের প্রতি হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হোয়াট ইজ ভার্বি ইজ ভার্বি। অর্থাৎ, যা বিগত তা বিগত।

নিজের দল নয়, নিজের গোত্র নয়, সবার আগে দেশ—ম্যান্ডেলা যে এ কথা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতেন, এর এক প্রমাণ মেলে ১৯৯৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব রাগবি প্রতিযোগিতা থেকে। প্রধানত শ্বেতকায়দের খেলা রাগবি, দক্ষিণ আফ্রিকা সেই খেলায় বিশ্বে সেরা। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর শ্বেতকায় খেলোয়াড়েরা নিজের দেশে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণে অনাগ্রহী ছিলেন। সাদা খেলোয়াড়দের এ নিয়ে অনুরোধ-উপরোধ করা হোক, ম্যান্ডেলার দলের অনেকেই তাঁর বিপক্ষে। কিন্তু ম্যান্ডেলা বললেন, ‘এই প্রতিযোগিতায় আমাদের শুধু অংশগ্রহণ নয়, তাতে জিততে হবে। নতুন দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের মানচিত্র স্থাপনে এর চেয়ে ভালো সুযোগ আর মিলবে না।’ তিনি রাগবি দলের ক্যাপ্টেন ফ্রাঁসোয়া পিয়েনারকে ব্যক্তিগতভাবে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর অফিসে চা খেতে। নিজ হাতে দুধ মেশানো চা খেতে দিয়ে তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললেন, দেশটা একা কালোদের নয়, তাঁরও। এই খেলায় বিজয়ের ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণভিত্তিক বিভাজন হ্রাস হবে। সুতরাং, তাঁকে জিততেই হবে। ম্যান্ডেলা সেদিন পিয়েনারকে জানিয়েছিলেন, সারা জীবন তিনি একটি কবিতার বাণী সত্য বলে জেনেছেন। জেলখানার বদ্ধ প্রকোষ্ঠে সে কবিতার চারটি লাইন তাঁকে অনুপ্রেরণা জোগাত। সেই কবিতা, দেড় শ বছর আগে উইলিয়াম হেনলির লেখা ‘ইনভিকটাস’-এর একটি কপি তিনি পিয়েনারের হাতে তুলে দেন। তার চারটি লাইন ছিল:

‘It matters not how strait the gate,/ How charged with punishments the scroll./ I am the master or my fate:/ I am the captain of my soul.’

ম্যান্ডেলার কথায় আশ্বস্ত হতে পিয়েনারের সময় লেগেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি কথা দিয়েছিলেন, মাদিবাকে তিনি হতাশ করবেন না। এক পিয়েনার নয়, দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেন ম্যান্ডেলা, তাঁদের অনুশীলনে কাউকে আগে থেকে না জানিয়ে একাধিকবার এসে হাজির হন। যেদিন নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে চূড়ান্ত খেলা, সেদিন ম্যান্ডেলা পিয়েনারের ২৬ নম্বর জার্সি গায়ে দিয়ে খেলা দেখতে আসেন। সেই দৃশ্য দেখে স্টেডিয়ামের সব মানুষ, তা সাদা হোক বা কালো, উল্লাসে ফেটে পড়ে। খেলায় বিজয়ী হয়ে সেবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। অধিনায়ক পিয়েনারের হাতে ট্রফি তুলে দিয়ে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য আপনি যা করলেন, তার জন্য ধন্যবাদ।’ জবাবে পিয়েনার বলেছিলেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য আপনি যা করলেন, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।’ পরে সেই আশ্চর্য বিজয়ের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে হলিউডের ফিল্ম ইনভিকটাস।

ম্যান্ডেলা শিখিয়েছেন, দেশকে বিভক্ত রাখা নয়, তাকে ঐক্যবদ্ধ করাই সফল রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রমাণ। আমাদের নেতা-নেত্রীদের অনুরোধ করব, ম্যান্ডেলার জীবনী হয়তো আপনারা পড়বেন না, কিন্তু ওই হলিউডি ছবিটি একবারের জন্য হলেও দেখুন। অন্ততপক্ষে এই একটি শিক্ষা ম্যান্ডেলার জীবন থেকে হয়তো পেয়ে যাবেন।

৩. নিজের প্রস্থানের সময় জেনে রাখা: ক্ষমতা গ্রহণের আগে-পরে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তায় ভূষিত হয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। বর্ণবাদী পেষণমুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য নতুন শাসনতন্ত্র তাঁর নেতৃত্বেই লিখিত হয়েছিল। তিনি চাইলে অনায়াসে নিজের জন্য আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট পদটি নির্ধারণ করতে পারতেন। নতুন শাসনতন্ত্র অনুসারেই নিদেনপক্ষে আরও এক দফা প্রেসিডেন্ট হতে পারতেন তিনি। কিন্তু না, এক দফা দায়িত্ব পালনের পর তিনি সরে দাঁড়ান। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার বদলে ক্ষমতার মধ্যমঞ্চ থেকে সরে দাঁড়ালেন, সুযোগ করে দিলেন পরবর্তী প্রজন্মের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সামনে আসতে। ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিন থেকেই ঘনিষ্ঠ সহচর থাবো এমবেকিকে প্রস্তুত করেছিলেন সেই দায়িত্ব পালনের জন্য।

তৃতীয় বিশ্বে এমন নেতা-নেত্রীর অভাব নেই, যাঁরা যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত। জিম্বাবুয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবের কথা ধরুন। ৩৩ বছর ধরে তিনি ক্ষমতায়। তাঁর দুঃশাসনে জিম্বাবুয়ে এখন প্রায় দেউলিয়া। রাজনৈতিক বিভক্তিতে দেশটি খণ্ডবিখণ্ড। বয়স ও ব্যাধির ভারে তিনি নিজেও ন্যুব্জ হয়ে এসেছেন, অথচ ক্ষমতা ত্যাগ করবেন না। ভয়, ক্ষমতা ছেড়ে দিলেই দেশের মানুষের কোপানলে পড়বেন।
অথচ মুগাবে তাঁর দেশে জাতির পিতার সম্মান পেয়েছিলেন। জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতাসংগ্রাম তাঁর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়েছিল। কখন সরে দাঁড়াতে হয়, এই কঠোর সত্য জানা থাকলে আজ তাঁকে সারা পৃথিবীর নিন্দা ও ধিক্কার শুনতে হতো না।

বস্তুত, তৃতীয় বিশ্বে অকুতোভয় নেতার অভাব নেই। যা অভাব, তা হলো ম্যান্ডেলার মতো ধীমান নেতৃত্বের। তিনি যে আজ বিশ্বের মানুষের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় নেতা। এর কারণ নিজের স্থান সম্বন্ধে তাঁর ছিল পূর্ণ সচেতনতা। তিনি জানতেন, ক্ষমতার মধ্যমঞ্চ থেকে কখন সরে দাঁড়াতে হয়।

আমাদের নেতা-নেত্রীরা কবে শিখবেন, গাছ-পাথর হয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মধ্যে কোনো গৌরব নেই।

নিউইয়র্ক

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।