যখন ইঁদুর ও বিড়াল দুজনেই খুশি

নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি

বিড়াল ও তার মুখে ধরা ইঁদুরকে যিনি একসঙ্গে হাসাতে পারেন, তিনি ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। তাঁর নির্বাচনে খুশি ইরানের জনগণ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট উভয়ই। অথচ ইরানিরা যতটাই মার্কিনবিরোধী, আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা ততই ইরানবিরোধী। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই এই আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক উভয়ের। অথচ সেই বিপ্লবেরই একজন বিশ্বস্ত সৈনিক, ইমাম খামেনির অনুগত হাসান রুহানির বিজয়ে খুশি পশ্চিমা রাষ্ট্রপ্রধানেরা। ইরানকে ভালো চেনে ইসরায়েল; কেননা উভয়ই মধ্যপ্রাচ্যের দুই অপরাজেয় খেলোয়াড়। ইসরায়েলিরা তাই বলছে, রুহানির বিজয়ে লাভ নেই, আসল ক্ষমতা তো সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনির হাতে। আসলেই হয়তো ইসরায়েলের লাভ নেই, কিন্তু কিছু লাভ হতে পারে ইরানের জনগণের। 
দুই রকম অবরোধের শিকার আজ ইরানি জনগণ। বড় অবরোধটা তাদের পেটে টান মারছে, ছোট অবরোধটা জ্বালা ধরাচ্ছে মনে। পাশ্চাত্য পরাশক্তিগুলোর অর্থনৈতিক অবরোধ ইরানের অর্থনীতিকে ভোগাচ্ছে, আর খামেনিতন্ত্রের রক্ষণশীল অনুশাসন তাদের বঞ্চিত করছে সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা থেকে। দিনের শেষে অর্থনীতিই মানুষকে টানে; তাই রুহানির অর্থনৈতিক ভরসার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তাদের টেনেছে। পাশাপাশি মধ্যপন্থী বলে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করার কৌশল প্রতিদ্বন্দ্বী রক্ষণশীল প্রার্থীদের থেকে তাঁর ভাবমূর্তিকে করেছে কম কঠোর। তবে এটা ভাবার কোনো সুযোগই নেই যে খামেনিতন্ত্রের ক্ষমতাকেন্দ্রের ঘরের লোক হাসান রুহানি আরেকজন ইরানি গরবাচেভ হবেন।
ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আকর্ষণটা একটু বেশি হওয়ার কারণ মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি। মজার বিষয় হচ্ছে, ইরান যেমন মার্কিন নির্বাচনের ফল নিয়ে উৎসুক হয়ে থাকে, যুক্তরাষ্ট্রও তেমনি ইরানের নির্বাচনকে আপন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে মনে করে। আর যুক্তরাষ্ট্র যে বিষয়ে আগ্রহী, সে বিষয়ে বিশ্বের গণমাধ্যমে তুমুল আলোচনা হবেই। এবারেও তাই হচ্ছে। কিন্তু বিদায়ী প্রেসিডেন্ট কট্টর জাতীয়তাবাদী আহমাদিনেজাদের বিপরীতে রুহানিকে পশ্চিমের কোমলাস্ত্র ভাবার কোনো কারণ নেই। ইরানের নির্বাচনী ব্যবস্থায়, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের জনগণের ভোটের দরবারে হাজির হওয়ার আগেই সর্বোচ্চ নেতা তথা অভিভাবক পরিষদের দরবারে পাস হয়ে আসতে হয়। সেই দরবারে এবার সংস্কারপন্থী বলে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট আলি আকবর রাফসানজানিসহ অনেকেরই মনোনয়ন বাতিল হলেও রুহানির হয়নি। এটাই প্রমাণ করে যে রুহানি ইরান বিপ্লবের অভিভাবকদের বিপক্ষের কেউ নন; বরং আস্থাভাজনদেরই একজন।
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদের চারিত্রিক চেহারাটায় একটা মিল হচ্ছে, উভয় দেশেরই চরমপন্থী ও উদারপন্থীর মধ্যে অমিল কেবল ভাষায়, কাজে তাঁদের মধ্যে পার্থক্য উনিশ-বিশ। জর্জ বুশ ও ওবামা দুজনই যুদ্ধ করেন, দুজনই ধনীদের ছাড় দেন এবং দুজনই নাগরিক স্বাধীনতাকে খর্ব করেছেন; তা হলেও ওবামা সাংস্কৃতিকভাবে কিছুটা উন্নত প্রকৃতির হওয়ায় তাঁকে ‘নরম’ প্রকৃতির মনে হয়। আহমাদিনেজাদের রুক্ষ চেহারা, পাশ্চাত্যের প্রতি কঠোর ভাষা এবং পরমাণুপ্রযুক্তি নিয়ে নাছোড়বান্দা মনোভাবের সঙ্গে নতুন প্রেসিডেন্ট রুহানির অমিলটাও ওই বাইরের দিকে। আহমাদিনেজাদ ইরানি ধাঁচের কোট পরা আদর্শবাদী আর রুহানি ধর্মীয় আলখাল্লা পরা বাস্তববাদী। আহমাদিনেজাদ রুহানির ভাষায় ‘পরমাণু কর্মসূচিতে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছেন; আমি ব্যয় করতে চাই অর্থনীতির স্বার্থে।’ মনে হতে পারে, রুহানি সম্ভবত পরমাণু বোমা বানানোর চেষ্টা থামিয়ে দেবেন; আমেরিকার সঙ্গে মিলমিশ করে নেবেন এবং দেশে বইয়ে দেবেন পাশ্চাত্য ধাঁচের ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ভোগবাদ।
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, যতই নম্রভাষী হন, আহমাদিনেজাদের চেয়েও রুহানি অনেক বেশি ধর্মতন্ত্রের কাছের মানুষ। আহমাদিনেজাদের দুই মেয়াদের আগের প্রেসিডেন্ট খাতামির সময় থেকেই রুহানি ইরানের পরমাণু প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন। বিপ্লবের পর থেকেই তিনি বিভিন্ন সময় ইরানের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আহমাদিনেজাদের সময়ও তিনি আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার সঙ্গে ইরানের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যান। সব মিলিয়ে রুহানি ইরানের ঐতিহ্যের মধ্য থেকেই কাজ করবেন; তবে তা করবেন আরেকটু বিনীতভাবে। প্রশ্ন তাহলে দাঁড়াল এখানে যে রুহানিই কি ইরানের পরিবর্তন আনবেন, নাকি ইরানের শাসকশ্রেণী থেকে শুরু করে জনগণের বড় অংশই যে পরিবর্তন প্রত্যাশা করে, তারই ফলাফল রুহানির নির্বাচন? দ্বিতীয় উত্তরটাই বেশি গ্রহণযোগ্য এ কারণে যে ইরানের শাসকেরা না চাইলে রুহানি নির্বাচিত হতে পারতেন না। ইরানের ধর্মীয় নেতারা নিজেরাই পররাষ্ট্রনীতি ও অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বদলের প্রয়োজন বোধ করছেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে এটা তাঁদের করতেই হবে। বলটা তাই চলে গেল যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে যে তারা কি ইসরায়েলি কূটনামিতে কান দিয়ে ইরানের ওপর অবরোধ আরও জোরদার করবে, নাকি রুহানির সঙ্গে মিলে দেওয়া-নেওয়ার খেলা খেলবে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক বাইরের দিক থেকে অনেক দা-কুড়াল চেহারা নিলেও আফগান ও ইরাক যুদ্ধে কিন্তু ইরান ভেতরে ভেতরে আমেরিকানদের সহযোগিতাই করেছে। এর সুফলও তারা পেয়েছে, উভয় দেশেই ইরানের প্রভাব আগের থেকে এখন বেশি। আবার ইরাক ও আফগানিস্তানকে শান্ত করায় এখনো ইরানের সাহায্য যুক্তরাষ্ট্রের লাগবে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতা চিরস্থায়ী করে ইরানও যে শান্তিতে থাকতে পারবে না, সেই উপলব্ধিও ইরানের শাসক মহলের থাকার কথা। তাই এখন প্রশ্ন হলো, ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল বিশ্বের কাছে যে সবুজ বার্তা বহন করে আনছে, পশ্চিমা বিশ্ব কি অনুরূপ বার্তা ইরানিদের দিতে প্রস্তুত? সিরিয়াকে ঘিরে ন্যাটো জোটের যুদ্ধচেষ্টার বাড়া-কমা থেকেই তা আমাদের বুঝে নিতে হবে।
অভ্যন্তরীণ দিক থেকে ইরান প্রমাণ করল যে নিজস্ব একধরনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা গড়ে তুলেছে, যেখানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ থাকে। ২০০৯ সালের নির্বাচনে অবশ্য ইরানিদের আধুনিক অংশ মনে করেছিল, তারা প্রতারিত হয়েছে। তাদের প্রার্থী মুসাভির জয় ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ সে সময় উঠেছিল। রাজপথে বিক্ষোভ এবং তার দমনের মর্মান্তিক চিত্রও বিশ্বজনমতকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। সেই ঘটনায় মুসাভির জয় নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একটা বিষয় উঠে এসেছিল যে তরুণ ইরানিরা তাদের শাসনব্যবস্থা নিয়ে খুশি নয়। এবারের নির্বাচনে ক্ষমতাকেন্দ্রের পক্ষ থেকে একজন মধ্যপন্থীর বিজয়কে স্বাগত জানানো থেকে মনে হয়, ২০০৯ সালের বিক্ষোভের বার্তা একেবারে বৃথা যায়নি।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]