যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রপনা ও একজন ডোনাল্ড ট্রাম্প

ট্রাম্প সমর্থকেরা ক্যাপিটল হিলে ঢুকে পড়েন।
ছবি: এএফপি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একক মোড়ল হিসেবে যে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এবং গত শতকের নব্বইয়ের দশকের পর যার একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারকরণ, তার ভিতে বড়সড় কুড়াল মারলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলা যায় অনুমিতভাবেই তিনি মার্কিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌধে আঘাত করলেন। এখন বিশ্বজুড়ে হায় হায় রব উঠেছে। গোটা বিশ্বের নেতারা এই ঘটনার নিন্দা জানাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আস্থা রাখার কথা বলছেন। এমনকি বিশ্বের যেসব নেতা একনায়কের মতো দেশ চালান, তাঁরাও মার্কিন গণতন্ত্রের এমন সঙিন দশায় এমনভাবে কপাল চাপড়াচ্ছেন, যেন মাত্রই তাঁরা সন্তান হারিয়েছেন। যদিও বাস্তবতাটি একেবারেই আলাদা; বলা যায় বিপরীত।

মোটাদাগে তথ্যগুলোর দিকে আগে নজর দেওয়া যাক। ৬ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উসকানিতে তাঁর কট্টর সমর্থক ও উগ্র রক্ষণশীল বিভিন্ন সংঘের হাজার হাজার লোক ক্যাপিটল হিলে হামলা করেন, যখন দেশটির নির্বাচনী ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হচ্ছিল কংগ্রেস ভবনে। গোটা দেশ থেকে মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষের সব আইনপ্রণেতা জড়ো হয়েছিলেন নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয়কে প্রত্যয়ন করতে। ফলে এই হামলা মূলত মার্কিন গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ব্যবস্থা মেনে এবং রাষ্ট্র নির্ধারিত ভূমিকা পালন ও একে রক্ষার শপথ নেওয়া বাছাই করা লোক ও কাঠামোর ওপর হামলা। এটি যেনতেন কথা নয়, যা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অধিকার আন্দোলনের সূত্র ধরে হবে হবে করছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের ক্ষমতার প্রতীককে নিরাপদ রাখতে পেরেছিল।

পেছন ফিরে বেশি দূর যেতে হবে না। ২০০০ সালের পর থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকট যখন ২০০৮-০৯ সালের দিকে বড় অর্থনৈতিক মন্দায় রূপ নেয়, তখন লাখো লোক বেকার হয়ে পড়ে। প্রকাশ্যে আসতে থাকে অর্থনৈতিক বৈষম্যের নানা চিত্র। এরই অবধারিত ফল হিসেবে ২০১১ সালে নিউইয়র্কের জুকুটি পার্কে ‘অকিউপাই ওয়াল স্ট্রিট’ নামের আন্দোলনে দলে দলে লোক ‘উই আর নাইনটি নাইন পারসেন্ট’ স্লোগান তুলে যোগ দেন। কিংবা এরপর অনুরূপ বিস্ফোরক আন্দোলন দেখা গিয়েছিল এই তো সদ্য বিগত বছরটিতে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামের সেই আন্দোলনটিও কিন্তু এভাবে ক্যাপিটল হিলে আছড়ে পড়তে পারত। কিন্তু পড়েনি। পড়েনি কারণ, গোটা পুঁজি কাঠামোর কোনো পর্যায়ের খেলোয়াড়ই একে সমর্থন করে না। কিন্তু ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা এই কাজটি করার নীরব সমর্থন ঠিকই পেয়ে গেলেন। এখন যখন রাষ্ট্র তার কর্তৃত্ব পুনর্বহাল করল, তখন এই সমর্থকেরা সরে দাঁড়াচ্ছেন।

‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ নামের সেই আন্দোলনটিও কিন্তু এভাবে ক্যাপিটল হিলে আছড়ে পড়তে পারত। কিন্তু পড়েনি। পড়েনি কারণ, গোটা পুঁজি কাঠামোর কোনো পর্যায়ের খেলোয়াড়ই একে সমর্থন করে না। কিন্তু ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকেরা এই কাজটি করার নীরব সমর্থন ঠিকই পেয়ে গেলেন।

এটা খুব মজার বিষয় যে গোটা পুঁজি ব্যবস্থা এমন এক গণতন্ত্র ও মুক্তমতের গল্প বলে, যা শব্দ দুটির সত্যিকার অর্থকে কখনোই প্রতিনিধিত্ব করে না। এ কারণে মজুরি, শিক্ষাসহ নানা নাগরিক অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা যেমন থাকে, তার থেকে একেবারে আলাদা থাকে জাতীয়তাবাদীসহ কট্টর যেকোনো ধারণার সমর্থনে হওয়া আন্দোলনের প্রতি তার আচরণ। ৬ জানুয়ারি ট্রাম্প সমর্থকদের করা ক্যাপিটল হিল হামলার সময় মার্কিন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। যেহেতু এই কদিন আগে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা একেবারে বিপরীত ছিল।

আরেকটু খতিয়ে দেখা যাক। উদারবাদী বলে পরিচিত ডেমোক্রেটিক পার্টি পরপর দুবার ভারমন্ট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন ঠেকিয়ে দিল। এ জন্য তারা বলা যায় সর্বশক্তি নিয়োগ করল। কারণ, স্যান্ডার্স প্রচলিত ধারার রাজনীতিক নন। তিনি নিজেকে খোলাখুলি সমাজতন্ত্রী বলেন এবং তিনি ও তাঁর সমর্থকেরা শ্রমিকের অধিকারসহ এমন অনেক বিষয়কে সামনে আনেন, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের উদারবাদী দলটিও অতি উদার বলে চিহ্নিত করে। এ ক্ষেত্রে ‘উদারবাদী’ দলটি তার নিজস্ব রক্ষণশীলতা থেকে বের হতে পারে না। অন্যদিকে রক্ষণশীল বলে পরিচিতি রিপাবলিকান দল ২০১৬ সালে ঠিকই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রাজনীতির বাইরের এক লোককে ঠিকই মনোনয়ন দিল। যদিও ট্রাম্পও স্যান্ডার্সের মতোই প্রচলিত রাজনীতিকে খারিজ করেন এবং এ বিষয়ে তাঁর কোনো লুকোছাপা নেই। কিন্তু তাঁকে এই মনোনয়ন পেতে ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে প্রায় সবগুলো স্তর সমর্থন দিয়েছে। ক্ষমতার চার বছর এবং ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল হামলার আগপর্যন্ত এই সমর্থনে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।

২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রচলিত ধারার রাজনীতির বাইরে দুজন ব্যক্তি কথা বলেছিলেন। একজন স্যান্ডার্স, অন্যজন ট্রাম্প। একজন ক্ষমতায় বসেছেন এবং নিজের তৈরি সব বিতর্ক থেকে তাঁকে গোটা কাঠামো বুক দিয়ে আড়াল করে রক্ষা করেছে। আর স্যান্ডার্স বিপুল তরুণের সমর্থন নিয়ে আরও একবার ঘরে ফিরে গেছেন। ট্রাম্পের মতো কোনো বিভাজন বা উগ্রবাদ উসকে না দিলেও ‘বিস্ফোরক’ বিবেচনায় রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের গভীরের রাষ্ট্র তাঁকে শুরু থেকেই উপড়ে ফেলতে চেয়েছে। এতে তারা সফলও বলা যায়। কথা হলো ডান ও বাম ধারা—এ দুই ধারার প্রতি রাষ্ট্রের আচরণের এমন পার্থক্য কেন?
পশ্চিমা ধারার গণতন্ত্রে শুধু সেই মুক্তমতকেই ‘বিস্ফোরক’ বিবেচনা করা হয়, যা সরাসরি শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের পক্ষে অবস্থান নেয়, প্রশ্ন করে গোটা ব্যবস্থাকে। এই ধারা খোলাখুলি কোনো ‘বামপন্থী’ অভিধা নেওয়া ধারা হতে পারে, না–ও হতে পারে।

ফলে এ ধরনের মুক্তমতের গলা টিপে ধরার জন্য রাষ্ট্রের হাত বরাবরই প্রস্তুত রাখা হয়। এই প্রস্তুতির জ্বালানিটি সরাসরি সরবরাহ করে বড় করপোরেশনগুলো। তারাই মূলত নির্ধারণ করে দেয়, কার কণ্ঠ কত দূর যাবে বা যাওয়া উচিত। অন্যদিকে ডানপন্থী কট্টরবাদকে সে বড়জোর একটা অস্বস্তি হিসেবে বিবেচনা করে কেবল। এই ধারার কট্টর হয়ে ওঠাকে সে বিপদ নয়, সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করে। বাজারকেন্দ্রিক সমীকরণে এই ধারাকে হামলাকারীর বদলে নতুন ক্রেতা হিসেবে বিবেচনা করে পুঁজি কাঠামো। কারণ, তারা ভালো করেই জানে, এই ধারাটি উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করার বদলে এর একচেটিয়াকরণে রাষ্ট্রের শক্তিটিকে কাজে লাগাবে। ফলে একে দমন বা নিয়ন্ত্রণের বদলে বরং বাড়তে দেয় তারা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো যুদ্ধ করেননি। কিন্তু তাঁর আমলে অস্ত্রের বেচাকেনা অন্য কোনো আমলের চেয়ে কম হয়নি। একইভাবে তাঁর আমলেই নিরাপত্তা সরঞ্জামের বিক্রি-বাট্টাও বেড়েছে। ফলে লাভটি দৃশ্যমান।

এই যে পুঁজির গোপন কৌশল, এই কৌশলটিই মূলত কাজ করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেড়ে ওঠা ও একচেটিয়া হয়ে ওঠায়। তাঁকে মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে প্রযুক্তি মোগল, এমনকি প্রচলিত ধারার রাজনীতিকদের প্রায় সবাই সমর্থন দিয়ে গেছেন। যদিও তিনি ছিলেন শুরু থেকেই ঘোষণা দিয়ে অপ্রচলিত। কট্টরবাদ ছড়ানোর মধ্য দিয়ে তিনি যে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তাঁকে এই গোষ্ঠীগুলো পুরোপুরি ব্যবহার করেছে। মূল হিসাবটি ছিল লাভের অঙ্কের। ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো যুদ্ধ করেননি। কিন্তু তাঁর আমলে অস্ত্রের বেচাকেনা অন্য কোনো আমলের চেয়ে কম হয়নি। একইভাবে তাঁর আমলেই নিরাপত্তা সরঞ্জামের বিক্রি-বাট্টাও বেড়েছে। ফলে লাভটি দৃশ্যমান।

পুঁজি কাঠামো ও একে ভিত ধরে গড়ে ওঠা পশ্চিমা গণতন্ত্র তো এই কাজটিই করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধু এর ওপরের উদার, মুক্তমত ইত্যাকার শব্দের মাধ্যমে তৈরি করা খোলসটি টেনে খুলে নিয়েছেন। আর এই খুলে নেওয়াতেই হায় হায় রবটি উঠেছে। কারণ, গোটা বিশ্ব গণতন্ত্র বা একনায়ক—যে অভিধাতেই হোক মূলত পুঁজির মডেলটির অনুসারী। ট্রাম্পের সৃষ্ট নৈরাজ্য তাই সবাইকে সাময়িক অস্বস্তি ফেলেছে। সাময়িক কারণ, ক্ষণিকের ও কট্টর ডানপন্থী এই নৈরাজ্য আদতে পুঁজির সৌধকে আরও কয়েক বছরের জন্য নিজেকে নিরাপদ রাখার নতুন কৌশল রপ্ত করার সুযোগ দিল।

স্থুল দৃষ্টিতে এতে একটা বিপ্লবী ঢং থাকলেও এটি বিপ্লব নয়, নয় নৈরাজ্যও। বরং সমাজে বিদ্যমান বিপ্লবী উপাদানগুলোকে জোট বাঁধার সম্ভাবনাকে এটি বহুলাংশে কমিয়ে দেয়। একজন ডোনাল্ড ট্রাম্পের পেছনে বিনিয়োগ করে মার্কিন করপোরেশন ও প্রচলিত রাজনীতি সফলই হয়েছে বলা যায়।


ফজলুল কবির লেখক ও সাংবাদিক
fazlul. kabir@gmail. com