যুদ্ধ ককেশাসে, হিসাব মধ্যপ্রাচ্যে

আজারবাইজানের বড় শহরগুলোতে হামলার অংশ হিসেবে সম্প্রতি দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম গানজা শহরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় আর্মেনিয়াএএফপি

প্রখ্যাত লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের জবানে আধুনিক দুনিয়ার সব জাতিগত হাঙ্গামার পেছনে ব্রিটিশদের ‘ভাগ করো; শাসন করো’ নীতি দায়ী। এই নীতি আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়াসহ পৃথিবীর নানান প্রান্তে রক্তারক্তির জাতিগত বিভেদের জন্ম দিয়েছে। বিভেদকে অবলম্বন করে উপনিবেশোত্তর ক্ষমতা কাঠামোয় নিজেদের প্রাসঙ্গিক রাখতে ব্রিটিশরা যেভাবে কাশ্মীর, সাইপ্রাস, মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দি সমস্যার সমাধান করেনি, একইভাবে বৃহৎ অর্থে সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়া, চেচনিয়া এবং পূর্ব ককেশাসের নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চলের মীমাংসা করেনি। এই অমীমাংসার দরুন আজও দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে। নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধকে লিবিয়া, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। কারণ এই অশেষ সংঘর্ষে ফ্রান্স, তুরস্ক, ইরান ও রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো জড়িয়ে পড়েছে। এবিসি নিউজের খবরে প্রকাশ, নাগোরনো কারাবাখ নিয়ে সৃষ্ট যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছে।

আধুনিক আজারবাইজানের জন্ম হয়েছিল অটোমান সাম্রাজ্যের হাত ধরে। অটোমানরাই প্রথম আজারবাইজানকে ১৯১৮ সালে একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল, বর্তমান তুরস্কের পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্ত থেকে রাশিয়াকে দূরে রাখা। ঠিক একইভাবে সে সময়ে আর্মেনিয়ানরা রাশিয়ান সাম্রাজ্যের সহযোগিতায় অটোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিল। এমনকি বর্তমান তুরস্কের একটি বৃহৎ অংশ দখলে নিয়েছিল। বলশেভিক বিপ্লবের পর উভয় দেশই সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সোভিয়েতের পুরো আমলে নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চল ‘স্বায়ত্তশাসন’ ভোগ করে। সোভিয়েতের শেষ সময়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন আর্মেনিয়ান খ্রিষ্টান অধ্যুষিত নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চলের ‘স্বায়ত্তশাসিত’ আইনসভা আর্মেনিয়ার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য একটি আইন পাস করে। নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চলের অবস্থান আজারবাইজানের জাতীয় সীমান্তের মধ্যে হওয়ার দরুন সেই ‘স্বায়ত্তশাসিত’ আইন না মেনে নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চলকে আজারবাইজানের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় বিশ্ব। পরবর্তী সময়ে নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে থেমে থেমে অসংখ্যবার সংঘর্ষ হয়েছে। আজারবাইজানের জাতীয় টেলিভিশন বলছে, প্রায় তিন দশকে হাজারের বেশিবার সংঘর্ষ হয়েছে দুই দেশের মধ্যে। এই সংঘর্ষ মেটাতে ১৯৯২ সালে মিনস্ক গ্রুপ নামে ফরাসি, রাশিয়ান ও মার্কিনদের নেতৃত্বে একটি সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংঘাত তো বন্ধ হয়নি বরং উল্লিখিত দেশগুলোর অস্ত্রের প্রধান ক্রেতা হয়েছে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান।

বিতর্কিত নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে আলোচনায় বসেছিল আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান
রয়টার্স

গত তিন দশকে সরকারি হিসাবেই এই সংঘর্ষে নিহত হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাবমতে তা প্রায় দুই লাখ। অতীতে যেকোনো সংঘর্ষে পশ্চিমের দেশগুলো সরাসরি ঘোষণা দিয়ে পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থাকত কিন্তু এই প্রথম ফরাসি ও ইরানিরা আর্মেনিয়ার পক্ষে এবং তুরস্ক আজারবাইজানের পক্ষে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছে। যার দরুন প্রথাগত যুদ্ধের বয়ান বদলে গেছে। তুরস্কের ড্রোন সহযোগিতা নিয়ে মাঠে আজারবাইজান চমক দেখিয়েছে আর আর্মেনিয়া ফরাসি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ড্রোন ধ্বংস করেছে। তবে আর্মেনিয়ার ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রীর কথায়। গত শনিবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল প্যাসিনিয়ান বলেছেন, ‘আমরা সম্ভবত হাজার বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছি।’ আজ আবার আল জাজিরা খবর দিয়েছে, আর্মেনিয়া মিনস্ক গ্রুপের কর্মনীতি অনুসারে আলোচনায় রাজি।

হঠাৎ এই যুদ্ধের গোড়া খুঁজতে গিয়ে বিশ্লেষকেরা খেই হারিয়ে ফেলেছেন। পূর্ব-লক্ষণ ছাড়াই শুরু হওয়া এই যুদ্ধের পেছনে ফরাসিদের হাত দেখছেন বিশ্লেষকেরা। ১৯৯২ সালে গঠিত মিনস্ক গ্রুপের অন্যতম প্রধান সদস্য ফ্রান্স। সদস্য হিসেবে ফ্রান্সের কর্তব্য সংঘর্ষ থামানো। কিন্তু সেই কাজে না গিয়েই মাখোঁ আর্মেনিয়ানদের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। এভাবেই এই সংঘর্ষে ফরাসিরা তাদের নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। আজারবাইজানকে সমর্থন দেওয়ার দরুন আঙ্কারাকে ‘বিপজ্জনক খেলা’ খেলার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। লিবিয়ায় আঙ্কারার অবস্থান নিয়ে একই অভিযোগ উঠিয়েছিল ফরাসিরা। আপাতদৃষ্টিতে লিবিয়ায় পরাজয়, ভূমধ্যসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েও কোনো ফলাফলের মুখ না দেখা এবং সর্বশেষ ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আঙ্কারার ওপর অবরোধ আরোপে রাজি করানোর ব্যর্থতা আর্মেনিয়াকে যুদ্ধের ময়দানে নামিয়ে ঢাকতে চাইছে ফরাসিরা।

ফরাসিদের মতো আর্মেনিয়ার পক্ষ নিয়ে ইরান আবার প্রমাণ করেছে যে ধর্ম নয়, বরং আঞ্চলিক স্বার্থই পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের মূল বিষয়। পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক অবরোধ, সৌদি বলয়ের ক্রমাগত যুদ্ধের হুমকিসহ প্রায় সব ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই তেহরানকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নীরব সমর্থন দিয়ে আসছে আঙ্কারা। সিরিয়ার যুদ্ধে দুই দেশ সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সচল থেকেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শিয়া মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ইরান আজারবাইজানের পক্ষাবলম্বন করেনি বরং আকাশ ও স্থলপথে আর্মেনিয়াকে সাহায্য করে চলছে ইরান। ইরানের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ আজারি কয়েক দশক ধরে ইরানের কুর্দিদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। এ ছাড়া সীমান্তসংক্রান্ত সমস্যা এবং কাস্পিয়ান সাগরের তেল-গ্যাস নিয়ে পুরোনো ঝামেলা তো রয়েছেই। এ সবকিছুকে সামনে রেখে ইরান আজারবাইজানকে শায়েস্তা করতে আর্মেনিয়ার পক্ষাবলম্বন করেছে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন রাশিয়াই ইরানকে আর্মেনিয়ার পক্ষে দাঁড় করিয়েছে। ইরানের এই অবস্থানকে সামনে রেখে যদি আগামী দিনে ইরানের ব্যাপারে আঙ্কারার অবস্থানে পরিবর্তন আসে, তাহলে ইরানের পক্ষে অভ্যন্তরীণ পরিমণ্ডলের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্থিতিশীলতা ধরে রাখা কঠিন হবে। কেননা আঙ্কারার সঙ্গে সঙ্গে দোহারও সমর্থন হারাবে ইরান।

সীমান্তকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধের দরুন একগুচ্ছ মানুষের তথাকথিত ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থের’ বলি হতে হয় সীমান্তবর্তী মানুষের। প্রাচ্যের দেশগুলো আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের চিন্তা এবং নির্মাণ; সীমানা এবং একক সংস্কৃতির মিথ চিত্রায়িত হয়েছে পশ্চিমা উপনিবেশবাদের কলমে, জন্ম হয়েছে জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ইতিহাস। বিভেদের এই ইতিহাসে নির্ভর করে যখন পশ্চিমা উপনিবেশবাদের স্থানীয় লোকরঞ্জনবাদী প্রতিনিধিরা ককেশাসে, কাশ্মীরে, ইরাকে, সিরিয়ায়, ইয়েমেনে, সুদানে কিংবা লিবিয়ায় মানুষের মধ্যে দেয়াল তুলে দিচ্ছেন, তখন পশ্চিমারা নিজেদের মধ্যকার সীমানা উঠিয়ে অখণ্ড এক ইউরোপিয়ান ভূমি গঠন করেছে। সীমানা ভাঙা-গড়ার এই ইতিহাস ক্রমাগতভাবে নিশ্চিত করে চলেছে পশ্চিমা আধিপত্যবাদ। তাই নাগোরনো কারাবাখ অঞ্চল নিয়ে এই আঞ্চলিক যুদ্ধ আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের একক যুদ্ধ নয় বরং পশ্চিমের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ।

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মানচিত্র
সংগৃহীত

সচেতন পাঠকেরা যদি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর প্রচারিত সংবাদের বাইরে গিয়ে স্বাধীনভাবে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার এই যুদ্ধকে বোঝার চেষ্টা করেন, তাহলে আগত মধ্যপ্রাচ্য এবং বৈশ্বিক শক্তি কাঠামোর সম্ভাব্য একটি রূপের আবছা অবয়ব দেখতে পারবেন। আদতে এই যুদ্ধের প্রধান দুই পক্ষ ফ্রান্স ও তুরস্ক। বর্তমান বিশ্বের প্রধান তিনটি গোলযোগ; সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ, ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস নিয়ে বিবাদ এবং আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের তুরস্কের সীমানাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে যেখানে মার্কিনদের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সও তুরস্কের প্রধান প্রতিপক্ষ। মার্কিনরা বর্তমানে করোনা মহামারি এবং নির্বাচন নিয়ে নিবিষ্ট থাকায় ফ্রান্স সাম্প্রতিককালে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সীমান্তের তিন দিকে যুদ্ধ পরিচালনা এবং ফ্যাকাশে অর্থনীতি নিয়ে মাঠে সবল থাকা আঙ্কারার পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে, তবে আঙ্কারার একমাত্র সম্বল আত্মবিশ্বাস আর ইতিহাস। অন্যদিকে ফরাসিরা সবদিক থেকেই এগিয়ে। তুরস্কের জাতীয়তাবাদীরা মনে করছেন, ২০২৩ সালে লোজান চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই পশ্চিমারা আরেকটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চায় তুরস্কের ওপর। সিরিয়া ও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ এবং ভূমধ্যসাগরের তেল-গ্যাস নিয়ে সৃষ্ট বিবাদের পর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার এই সংঘর্ষ আগত যুদ্ধের সম্ভাব্য ইশারা।

রাহুল আনজুম: আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক গবেষক।