রংপুর বিভাগের জন্য কী বরাদ্দ?

এ রকম একটা সময়ে ১৭ মে রংপুর বিভাগের আটটি জেলার বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের এক প্রাক্-বাজেট আলোচনা হয়ে গেল রংপুরের বেগম রোকেয়া মিলনায়তনে। আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের বেশির ভাগ সূচকের নিরিখে রংপুর বিভাগ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় পিছিয়ে আছে এবং এই উন্নয়ন-ব্যবধান কমিয়ে আনতে গেলে অবশ্যই জাতীয় বাজেটে রংপুর বিভাগের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের উপস্থিতিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. মোরশেদ হোসেনের মূল উপস্থাপনার সূত্র ধরে আলোচকেরা দুটো দিকের ওপর আলোকপাত করেন। প্রথমত, কেন রংপুর বিভাগের জন্য জাতীয় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দরকার; দ্বিতীয়ত, এই দরকার সর্বমহল উপলব্ধি করার পরও কেন সরকার বাজেট বরাদ্দ করার ক্ষেত্রে সেটা মনে রাখে না। আলোচনায় উপস্থাপিত তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা শতকরা ৩১ দশমিক ৫ ভাগ হলেও রংপুর অঞ্চলে ৪৬ দশমিক ২ শতাংশ অধিবাসীই দরিদ্র। পরিস্থিতি যে শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বেশি নাজুক, তা বলাই বাহুল্য। খুলনা বিভাগে ৩২ দশমিক ১ ভাগ মানুষ দরিদ্র, অথচ সেখানে ৩৭ দশমিক ৩ ভাগ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের সহায়তা পায়! পক্ষান্তরে ৪৬ দশমিক ২ ভাগ দরিদ্র-অধ্যুষিত রংপুর বিভাগের মাত্র ৩৩ দশমিক ৬৫ ভাগ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা বাজেট বরাদ্দ ছিল এর আগের বাজেটে। রংপুর বিভাগের মানুষের খানাওয়ারি বার্ষিক আয় ও ব্যয় পুরো দেশের আঞ্চলিক চিত্রের তুলনায় নিম্নতম।

এই বিভাগের মাত্র ৩০ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা পায়, টেলিফোন ব্যবহারকারী ১ দশমিক ৪ শতাংশ, মোবাইল ব্যবহার করে ৪১ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং কোনো না কোনোভাবে কম্পিউটার সুবিধা পায় ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। এই চিত্র এ বিভাগের মানুষের প্রকট অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার ইঙ্গিত দেয়।  প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ না থাকার কারণে প্রাক্কলিত উৎপাদন ব্যয় বেশি হওয়ায় এবং ব্যাংকগুলোর ঋণদান-প্রক্রিয়া উদ্যোক্তাবান্ধব না হওয়ায় রংপুর বিভাগে শিল্পায়নের সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে রংপুর বিভাগের কর্মীদের অংশগ্রহণ বিশাল। অতএব, রংপুর অঞ্চলেই তো গড়ে উঠতে পারে পোশাকশিল্প কারখানা। তার জন্য এই অঞ্চলে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। কৃষিপ্রধান এই অঞ্চলে সবজি, ফল; বিশেষ করে কলা, লিচু, হাঁড়িভাঙা আম, সূর্যপুরি আম ও আলুর মতো কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে উঠতে পারে।

রংপুর বিভাগের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। পচনশীল কৃষিপণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকেরা বাধ্য হন তাঁদের শ্রমে ও ঘামে ফলানো ফসল তাৎক্ষণিকভাবে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে তুলে দিতে। কৃষিপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল, ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের সংযোগ সাধনকারী সেতুগুলোর যেকোনোটির টোলের চেয়ে বেশি। এ পরিস্থিতি এই অঞ্চলের কৃষিপণ্য বাজারজাতকে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল করে তুলেছে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে রংপুর বিভাগের চিত্র হতাশাজনক। এ বিভাগের শতকরা মাত্র একজন নাগরিক আন্তর্জাতিক অভিবাসনের সুযোগ পান। এ ক্ষেত্রে রংপুর বিভাগের নাগরিকদের দক্ষতা উন্নয়নের বিশেষ কার্যক্রম হাতে নেওয়া দরকার।

ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস করার কৌশল ও নীতি হিসেবে বলা হয়েছে, ‘প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া ইনক্লুসিভ হতে হবে এবং মানব উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের প্রতি জোর দিতে হবে।’ আরও বলা হয়েছে, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী পিছিয়ে পড়া অঞ্চলসমূহ মাথাপিছু ভিত্তিতে উন্নয়ন ব্যয়ের অপেক্ষাকৃত কম বরাদ্দ পায়। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার অন্যতম নীতি হলো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির কাঠামোতে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলসমূহের উন্নয়নের জন্য পৃথক বরাদ্দ রাখা। অধিকন্তু, যেসব প্রকল্প আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য সহায়ক, সেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া।’ সুতরাং, নীতিমালার ভিত্তিতেই পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসেবে এবং নবগঠিত বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগকে জাতীয় উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সক্ষম করে তোলার জন্য এই বিভাগে সরকারকে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়ার কার্যক্রম হাতে নিতেই হবে।

তবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন মনে করেন, রংপুর অঞ্চলের উন্নয়ন-বৈষম্য বজায় থাকার পেছনে কেবল বিশেষ বরাদ্দ না থাকাই একমাত্র কারণ নয়। এই বিভাগে জাতীয় সংসদের ৩৮টি আসন আছে। তাঁরা আঞ্চলিক ইস্যুতে কখনোই একসঙ্গে কাজ করেননি। রংপুর অঞ্চলের উন্নয়নে বিশেষ বরাদ্দ বা বিশেষ প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে চাপ দিতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, রংপুর বিভাগের ভোটারদের আরও সচেতন হওয়ার দরকার আছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় পরিচালকের মতে, বরাদ্দকৃত টাকা সময়মতো ছাড় না হওয়াও একটি প্রকট সমস্যা। অর্থবছরের এমন এক সময়ে টাকা মাঠপর্যায়ে পৌঁছায়, তখন তড়িঘড়ি করতে গিয়ে আর মানসম্মতভাবে কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যায় না। সেই সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিরা যাতে সঠিকভাবে বরাদ্দকৃত বাজেট ব্যবহার করতে পারেন, সে লক্ষ্যে তাঁদের দক্ষতা উন্নয়ন খাতেও বাজেট বরাদ্দ রাখা দরকার।

রংপুর বিভাগের উন্নয়নের বহু সম্ভাবনা তৈরি হয়ে আছে। এই অঞ্চলের কয়লাখনি থেকে কয়লা উত্তোলনের পদ্ধতি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার অবসান ঘটানোর দায়িত্বও সরকারের। এই বিভাগের রেলযোগাযোগের নানামুখী উন্নয়নের কথা বহুদিন থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে। এই বিভাগে প্রাপ্ত উৎকৃষ্ট মানের কঠিন শিলা আহরণ করেও এখানকার উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করা যায়।

সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্রের বিস্তীর্ণ চরগুলোতে ইউরেনিয়ামসহ বেশ কিছু মহামূল্যবান পদার্থের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে স্থানীয় মানুষের দক্ষতা উন্নয়নে অর্থব্যয় করতে হবে। রংপুর বিভাগের উন্নয়নের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী নিজে নিয়েছিলেন; এর প্রতিফলন বাজেটে থাকবে—এটাই মানুষের প্রাণপণ প্রত্যাশা।

শান্ত নূরুননবী: উন্নয়নকর্মী।