রংপুরে এ কোন দুর্ভোগের জ্বালা

রংপুর নগরের কোথাও এখনো হাঁটু পানি। সোমবার নগরের কোতোয়ালি থানা সড়ক এলাকা
ছবি: মঈনুল ইসলাম

কয়েক দিন আগে আলী হোসেন নামের এক বৃদ্ধ বলছিলেন, ‘সারা জীবন রংপুরোত কাটিল। শহরোত এত পানি উটপার দেখি নাই। এলা ঝরি (বৃষ্টি) হইলেই সড়ক ডুবি যায়, বাড়িত পানি ওঠে।’ এই কথা রংপুরে যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বাস করছেন, তাঁদের সবার। প্রাকৃতিক কারণে শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়নি; হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ আর দুর্বল পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থার জন্য।

বাংলাদেশের পরিচ্ছন্ন এবং বসবাসের উপযোগী শহর হিসেবে রংপুর ছিল অনন্য। যত বৃষ্টিই হোক না কেন, এই শহরে পানি জমে থাকত না। এর অন্যতম কারণ, শহরের ভেতরেই আছে কয়েকটি পানির প্রবাহ। রংপুর জেলায় নদীর সংখ্যা প্রায় ৩৩টি। রংপুর সিটি করপোরেশনের মধ্যেই ৬টি নদী আছে। এগুলো হলো ঘাঘট, খোকসা ঘাঘট, বুড়াইল, শ্যামাসুন্দরী, ইছামতী ও আলাইকুমারী। এ ছাড়া কেডি খাল বলে একটি খালও আছে। এ শহরে প্রায় ১০ লাখ মানুষের বাস। ২০৭ বর্গ কিলোমিটারের এ শহরের জনসংখ্যা বাংলাদেশের অন্য শহরের তুলনায় অনেক কম। তারপরও শহরের অবস্থা এমন বেহাল।

রংপুর শহরের পানি নেমে যাওয়ার সহজ পথ আছে। রংপুর শহরের দক্ষিণাংশের পানি অনায়াসে নেমে যেতে পারে খোকসা ঘাঘট নদে। পশ্চিমাংশের পানি নেমে যেতে পারে ঘাঘট নদে। শহরের মধ্যবর্তী অংশের অর্ধেক পানি শ্যামাসুন্দরীতে, আরেক অংশের পানি কেডি খাল দিয়ে নেমে যেতে পারে। শহরের উত্তরের পানি নেমে যেতে পারে বুড়াইল নদী দিয়ে। মাহিগঞ্জের পানি নেমে যেতে পারে ইছামতী-আলাইকুমারী নদী হয়ে। বাংলাদেশে এমন শহর খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, যে শহরের ভেতরে ৬টি প্রাকৃতিক পানির প্রবাহ আছে। তারপরও জলাবদ্ধতা নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত হচ্ছে। সীমাহীন অবহেলা থাকলেই কেবল এমনটি সম্ভব। গত কয়েক বছরে যে ড্রেন তৈরি করা হলো তা পানি নিষ্কাশনে তেমন কাজে লাগছে না।

২৬ তারিখ রাত থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর সকাল পর্যন্ত প্রায় ৪৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। কিন্তু এই বৃষ্টিপাত ছাড়াও দুবছর থেকে রংপুরে জলাবদ্ধতায় নগরবাসীর জীবন বিপর্যস্ত। মূলত দুই বছর থেকে শহরে জলাবদ্ধতা বাড়ছে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা না গেলে পুরো বর্ষাকাল রংপুর শহর জলমগ্ন হয়ে থাকতে পারে। গত বছরেও একটানা দীর্ঘক্ষণ বৃষ্টিতে অনেক স্থানে সড়ক ছিল পানির নিচে। এ বছর একটানা বৃষ্টিতে শহরের অনেক সড়কই কয়েক দফায় পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অথচ রংপুরের মতো উঁচু একটি শহর, যার চারদিকে এবং মাঝ বরাবর নদী আছে, সেই শহরে এক মিনিটের জন্যও পানি জমে থাকার কোনো কারণ নেই। যখন এ লেখা লিখছি, তখনো শহরের অধিকাংশ এলাকাই ডুবে আছে।

সামান্য বৃষ্টিতে কেন পানি নেমে যায় না, তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ঘাঘট নদের শাখা হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী। বাস্তবে এখন শ্যামাসুন্দরীর তলদেশ ঘাঘটের চেয়ে প্রায় ১০-১৫ ফুট উঁচু। এর ফলে শ্যামাসুন্দরী যে পরিমাণ পানি আগে বহন করতে পারত, এখন পারে না। আগে ঘাঘট নদের অনেক পানি এ নদী দিয়ে প্রবাহিত হতো। তখন এ নদীতে জমে থাকা অনেক ময়লা ধুয়ে নিয়ে যেত ঘাঘটের পানি। বর্তমানে শ্যামাসুন্দরী শহরের মানুষের কাছে একটি ভাগাড়মাত্র। সিটি করপোরেশন এবং বিভাগীয় প্রশাসন শ্যামাসুন্দরী পরিষ্কার রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও নদীর দুপারের মানুষের কারণে তা এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। পানির ধারণক্ষমতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। এ নদীর উন্নয়নের যে কাজ চলছে, তা এখনো আশার মুখ দেখতে পারেনি।

ঢাকার পরপরই এখন সবচেয়ে অপরিকল্পিত শহর রংপুর। ঢাকাকে বসবাসের উপযোগী করার জন্য সরকারের তবু চেষ্টা আছে। অসময়ের চেষ্টা হওয়ার কারণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেও কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না। রংপুরের সেই চেষ্টাও নেই। বাংলাদেশের বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী শহর হয়ে ওঠার আশঙ্কা আছে রংপুরের। ‘সময়ের একফোঁড় অসময়ের দশফোঁড়’-এর মতো রংপুরের দশাও হবে। শহরের জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য রংপুর সিটি করপোরেশনের সক্ষমতা থাকা জরুরি। নাগরিকদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণ কর গ্রহণ করা হয়। তার বিনিময়ে যদি জলাবদ্ধতামুক্ত শহরের সেবাও দেওয়া না যায়, তাহলে অন্যান্য সেবা পাওয়া অসম্ভব হবে।

রংপুর সিটি করপোরেশনের বয়সও প্রায় ১০ বছর। এই ১০ বছরে শহরের একটি মাস্টারপ্ল্যানই প্রস্তুত করা সম্ভব হয়নি। পয়োনিষ্কাশন এবং বর্জ্যব্যবস্থাপনাও অত্যন্ত নাজুক। শহরের সব কটি সড়ক এখনো পাকা হয়নি। কাঁচা সড়কে বর্ষায় চলাচল অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। নগরের মাস্টারপ্ল্যান, উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ কিংবা চাহিদাভিত্তিক অধিকার আদায় করার জন্য সরকারি দলের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি। কিন্তু সেই সমন্বয় সুদূরপরাহত। সরকারিভাবে রংপুরের সঙ্গে আছে বিমাতাসুলভ আচরণ, আছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকট। এ অবস্থায় রংপুর সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের কোনো আশার আলো নেই।

সিটি করপোরেশন হওয়ার পর সরকারিভাবে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে নাগরিক সুবিধা যে বৃদ্ধি করা, তা আজ পর্যন্ত হয়নি। যদি সরকারিভাবে বিশেষ বরাদ্দ না থাকে, তাহলে এ শহরে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। দেশের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারের যে টাকা বরাদ্দ থাকে, তার এক শতাংশেরও কম বরাদ্দ থাকে রংপুর বিভাগের দুই কোটি মানুষের জন্য। সেখানে রংপুর সিটি করপোরেশনের জন্য বিশেষ বরাদ্দ পাওয়ার আশা করাটা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্বাভাবিক বরাদ্দই কম, বিশেষ বরাদ্দ তো অনেক দূরের কথা।

চারদিকে নদীবেষ্টিত রংপুর শহর এখনো হয়ে উঠতে পারে আদর্শ শহর। এই শহরে অনেক জমি খালি পড়ে আছে। ইচ্ছেমতো এ শহরকে সাজানো সম্ভব। এর জন্য উপযুক্ত নেতৃত্ব চাই, চাই দলীয় ভেদাভেদ ভুলে রংপুরের উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করা। প্রয়োজনে সুশীল সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো দলাদলি হবে, উন্নয়ন হবে না। যদি আমরা ঐকমত্যের ভিত্তিতে দাবি তুলতে পারি, তাহলে সরকারি সহায়তা বাড়ানো সম্ভব। এতে শহরের জলাবদ্ধতা দূরীকরণসহ অন্য সব নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাও সহজ হবে।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক