রাজনীতি, বাণিজ্য ও সুরক্ষা

বাংলাদেশ বেগুনের আদি জন্মভূমি। উদ্ভিদবিজ্ঞানের ভাষায় প্রজাতির উৎপত্তিস্থল। উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডি ক্যান্ডোল ১৮৮৬ সালে চাষকৃত ফসলি উদ্ভিদের উৎপত্তিস্থল নিয়ে লেখেন অরিজিন অব কাল্টিভেটেড প্ল্যান্ট। ওই বইয়ে তিনি বেগুনকে (Solanum melongena L.) এশিয়া অঞ্চলের স্থানীয় উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করেন। রুশ বিজ্ঞানী এন আই ভালিবভ ১৯২৮ সালে বেগুনকে ‘ইন্দো-বার্মা’ অঞ্চলের ফসল হিসেবে বর্ণনা করেন। ইশিকি ও অন্যরা ভারতীয় অঞ্চল থেকে সংগৃহীত বেগুনের এনজাইম ও অঙ্গসংস্থানিক ধরন বিশ্লেষণ করে ১৯৯৪ সালে এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ বৈচিত্র্যময় বেগুনের অঞ্চল। বেগুন বাংলাদেশে সারা বছরই চাষ হয় এবং দেশের সবজি উৎপাদনের মোট জমির
১৫ শতাংশ জমিতে বেগুনের আবাদ হয় (সূত্র: কৃষি তথ্য সার্ভিসের ওয়েবসাইট)। দেশে মোট এক লাখ ১৫ হাজার ৪২৪ একর জমিতে বেগুনের চাষ হয় (সূত্র: বিবিএস ২০১০)।

বিটিবেগুন-বৃত্তান্ত
জিনপ্রযুক্তির মাধ্যমে বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকা মারার জন্য বেগুনের ভেতর একটি ব্যাকটেরিয়ার জিন ঢুকিয়ে গবেষণাগারে তৈরি
করা হয়েছে বিটিবেগুন। মাটির একটি ব্যাকটেরিয়ামের বৈজ্ঞানিক নাম ‘ব্যাসিলাস থুরিনজিএনসিস’। তো বেগুনে ঢোকানো ব্যাকটেরিয়াটির নামের ‘বি’ এবং ‘টি’ নিয়ে জিনটির নাম দেওয়া হয়েছে বিটি জিন, এ জিন বেগুনের ফল ও ডগা ছিদ্রকারী পোকাকে মেরে ফেলতে পারে। বিটি জিন ঢোকানো হয়েছে বলে এর নাম বিটিবেগুন।
বিটি জিন এবং বিটি জিনপ্রযুক্তির মেধাস্বত্ব ও মালিকানা মার্কিন বহুজাতিক কৃষিবাণিজ্য কোম্পানি মনস্যান্টোর। ভারতীয় করপোরেট কোম্পানি মাহিকো মনস্যান্টোর এ বিটি জিনপ্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমোদন লাভ করে। পরে মাহিকো কোম্পানির এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিটিবেগুন উৎপাদন
ও ব্যবহারের জন্য ‘পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের’ মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভারত ও ফিলিপাইনকে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ‘কৃষি প্রাণপ্রযুক্তি সহায়তা প্রকল্প-২’ নামে ২০০৫ সালে বিটিবেগুন প্রকল্প চালু হয় মার্কিন দাতা সংস্থা ইউএসএইডের সহায়তায়।
২০০৫ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি), মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি লিমিটেড (মাহিকো) এবং কৃষি প্রাণপ্রযুক্তি সহায়তা প্রকল্প-২-এর পক্ষে সৎগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্টস প্রাইভেট লিমিটেড এক ত্রিপক্ষীয় ‘সৎগুরু চুক্তি’ স্বাক্ষর করে। বারির তথ্যমতে, ২০০৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বারি মাহিকো কোম্পানির সঙ্গে ‘ম্যাটেরিয়াল ট্রান্সফার এগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করে।
২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারি কৃষিমন্ত্রী গাজীপুর, পাবনা, রংপুর ও জামালপুরের কৃষকদের হাতে প্রশ্নহীনভাবে বিটিবেগুনের চারা তুলে দেন। অথচ নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩-এর পঞ্চম অধ্যায়ে ‘নিরাপদ খাদ্যসংক্রান্ত বিধিনিষেধ’ অংশে ৩২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা তাহার পক্ষে নিয়োজিত অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, প্রবিধান দ্বারা বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনের অধীন নির্ধারিত পদ্ধতিতে অনুমোদন গ্রহণ ব্যতিরেকে বংশগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনকৃত বা সংশোধিত খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ বা বিক্রয় করিতে পারিবেন না’।
বিটিবেগুন ও প্রাণপ্রযুক্তির বিপদ নিয়ে সাহসী প্রতিবাদ বাংলাদেশেও দানা বাঁধে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সরকার এখন পর্যন্ত বিটিবেগুন নিয়ে জনগণের আপত্তি, আশঙ্কা ও আওয়াজের কোনো ন্যায্য উত্তর দেয়নি।

বেগুনের মেধাস্বত্ব ডাকাতি
‘সৎগুরু চুক্তি’ অনুযায়ী বাংলাদেশের উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা, শিংনাথ, দোহাজারী, চ্যাগা, খটখটিয়া, ইসলামপুরী ও ঈশ্বরদী লোকাল—এ নয়টি বেগুনের জাতকে বিটিবেগুন গবেষণা প্রকল্পের জন্য অনুমোদন দেয় বারি। এগুলোর মধ্যে নয়নতারা জাতটির উৎপত্তিস্থল ভারত, ১৯৯৮ সালে বারি একে দেশে চাষের অনুমোদন দেয়।
চুক্তির ১.১৯ নম্বর শর্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে, বিটিবেগুন প্রকল্পে ব্যবহূত বিটি জিন, বিটি প্রযুক্তি এবং এ প্রযুক্তির মাধ্যমে উদ্ভাবিত বা বিক্রয়যোগ্য সব বিটিবেগুনের ওপর মেধাস্বত্ব অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ মনস্যান্টো কোম্পানির। মনস্যান্টোর পেটেন্টকৃত বিটি জিন বাংলাদেশি বেগুনে ঢোকানোর ভেতর দিয়ে ওই চুক্তি মোতাবেক এখন মনস্যান্টো বাংলাদেশের উল্লিখিত বেগুনের ওপর তার কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের বৈধতা পেয়েছে।
সংবিধানের ১৮ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করবে। দেশের বেগুনের জাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র দেশের সম্পদ অন্যায়ভাবে কোনো করপোরেট জিম্মায় তুলে দিতে পারে না। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদও এ ধরনের জিনদস্যুতার বিরোধী। দেশে এমন কোনো আইন বা নীতি নেই, যা দেশের কোনো প্রাণসম্পদের ওপর বহিরাগত কোনো বহুজাতিক কোম্পানির মেধাস্বত্ব মালিকানাকে বৈধতা দেয়। এটি অন্যায়। তাই মনস্যান্টো, সিনজেনটা, বায়ার ক্রপ সায়েন্সের মতো বহুজাতিক কোম্পানির জিনদস্যুতা ও প্রাণসম্পদ ডাকাতির বিরুদ্ধে বৈশ্বিক গণপ্রতিরোধ তুমুল।

বিটিবেগুনকে ‘না’, দেশি বেগুনকে ‘হ্যাঁ’
২০১০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বিটিবেগুন নিষিদ্ধ করেছে। পরে নিষিদ্ধ করেছে ফিলিপাইন। স্বাস্থ্য, পরিবেশ, বাণিজ্য, মেধাস্বত্ব, প্রতিবেশ ও সংস্কৃতি প্রশ্নে বিটিবেগুনসহ জিএম খাদ্য-ফসল ঘিরে বিতর্ক আজ বৈশ্বিক। স্বপরাগী হলেও বেগুনের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য হারে পরপরাগায়ণ ঘটে, কখনো তা প্রায় শতকরা ৪৮ ভাগ। পরাগায়ণের মাধ্যমে প্রকৃতিতে বিটিবেগুনের বিকৃত জিন ছড়িয়ে পড়লে তা ভয়াবহ জিনগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে, যা সামাল দেওয়া অসম্ভব।
ড. ল্যু এম গাল্লাঘের, অধ্যাপক গিলেস এরিক সেরালিনিসহ অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক বিটিবেগুনের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপদসমূহ প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। রাষ্ট্রকে অবশ্যই বিটিবেগুন প্রশ্নে দেশি বেগুন ঘিরে দেশের প্রাণসম্পদ ও জনগণের ঐতিহাসিকতার বিজ্ঞানকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিটিবেগুন প্রকল্প ও চুক্তির জনযাচাই জরুরি। দেশীয় বেগুনের বৈচিত্র্য ও মেধাস্বত্ব সুরক্ষা রাষ্ট্রকেই দিতে হবে। বিটিবেগুন নয়, দেশি বেগুনের জাত ও দেশীয় কৃষিজ চর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে বেগুনের জাত ও উৎপাদনের বিকাশ ঘটানো সম্ভব। পাশাপাশি বেগুনে বহুজাতিক কোম্পানির অবাধ বিষ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।
কেবল বেগুন কেন, পুরো কৃষি ও জুমব্যবস্থাকেই আজ বহুজাতিক কৃষিবিষের অন্যায় বাণিজ্য থেকে মুক্ত করা জরুরি। বাংলাদেশে প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে বেগুন গবেষক ঈশ্বরচন্দ্র গুহ বেগুন গবেষণার ফলাফল নিয়ে ১৩২১ বঙ্গাব্দে মন্তব্য করেন, বিদেশি বীজের প্রতি আস্থাবান না হয়ে যত্নসহ এদেশীয় উন্নতমানের বেগুনের চাষ করলে নিশ্চয়ই আমাদের পূর্ব সুনাম বজায় থাকবে ও কৃষক তাঁর উৎপাদিত ফসলের জন্য অধিক মূল্য পাবেন। আসুন, দেশি বেগুন ও দেশের জনগণের ওপর পূর্ণ আস্থার সীমানা বিস্তৃত করি।

পাভেল পার্থ: গবেষক, প্রতিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ।
[email protected]