রাষ্ট্র-বাজার ভারসাম্যে সংস্কার সাধন

গত ৩০ বছরে চীন যত দ্রুত উন্নতি করেছে, পৃথিবীর লিখিত ইতিহাসে কোনো দেশ তা করতে পারেনি। এত বেশিসংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনতে পারেনি। চীনের এই উন্নতির বিশেষত্ব হচ্ছে, দেশটির নেতারা যখন যেমন প্রয়োজন বোধ করেছেন, তাঁদের অর্থনৈতিক মডেল ঠিক সেভাবে ঢেলে সাজিয়েছেন। শক্তিশালী কায়েমি শক্তিগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁরা এ লক্ষ্যে সফল হয়েছেন। এ মুহূর্তে চীন যখন আরেক দফা মৌলিক সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তখন কায়েমি শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সংস্কারবাদীরা কি আবারও জয়ী হবেন?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সেটা হচ্ছে, অতীতের মতো চলমান সংস্কার কর্মসূচি শুধু অর্থনীতির পুনর্গঠন করবে না, কায়েমি স্বার্থের রূপটাও এতে পুনর্গঠিত হবে। এতে করে ভবিষ্যৎ সংস্কারের গতিমুখও নির্ধারিত হবে (এবং সেগুলো সম্ভব কি না, তাও নির্ধারণ করবে)। বর্তমানে অতি প্রয়োজনীয় উদ্যোগগুলো, যেমন সরকারের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতিবিরোধী প্রচারণা, যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করলেও রাষ্ট্র ও বাজারের যথাযথ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া এখন চীনের প্রধান বিবেচ্য বিষয়।
তিন দশক আগে চীন যখন সংস্কার কর্মসূচি হাতে নেয়, তখন এর গতিপথ ছিল পরিষ্কার: সম্পদ বণ্টনে বাজারকে আরও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। সেটা ঘটেছে। বেসরকারি খাত যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, সেখানে বৃহত্তর মতৈক্য সৃষ্টি হয়েছে, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত খাতগুলোতে, দাপ্তরিক ভাষায় যাকে বলে বাজারকে, ‘নীতিনির্ধারণী ভূমিকা’ পালন করতে হবে। কিন্তু সাধারণভাবে অন্যান্য খাতে ও অর্থনীতিতে এর ভূমিকা কী হবে?
চীন এখন যেসব সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে, তার অনেকগুলোই বাজারের অতিরিক্ত ও সরকারের নগণ্য ভূমিকা পালনের ফল। বা অন্যভাবে বললে, সরকার এমন কিছু করছে যা তার করার কথা নয়, আর তার যা করার কথা সেটা করছে না। উদাহরণস্বরূপ, ক্রমবর্ধমান পরিবেশদূষণ জীবনযাত্রার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। উপার্জন ও সম্পদের বৈষম্যের দিক থেকে চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হয়ে উঠছে। এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় খাতেই দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। এসব মিলে সমাজে ও রাষ্ট্রে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দেখা যাচ্ছে, খাদ্যনিরাপত্তার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রবণতা দৃশ্যমান। এসব সমস্যা আরও ঘনীভূত হতে পারে চীনের নীতির কারণেই। তারা বর্তমানে রপ্তানিমুখী প্রবৃদ্ধির চেয়ে সেবা খাত ও মানুষের ভোগভিত্তিক প্রবৃদ্ধির দিকে ঝুঁকছে। সেখানে এই ক্রয়ভিত্তিক প্রবৃদ্ধির সুযোগ নিশ্চিতভাবেই রয়েছে। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোগবিলাসী অপচয়ী সমাজ চীনের জন্য এবং পৃথিবীর জন্যও বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। বায়ুর গুণমান ইতিমধ্যেই চীনের মানুষদের জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। চীনের মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ সারা দুনিয়াকেই হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। নবীনদের জন্য ভালো কৌশল রয়েছে একটি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার ঘাটতি মোকাবিলায় সম্পদের বণ্টন হলে সেখানকার মানুষদেরও জীবনযাত্রার মান বাড়তে পারে। এখানে সরকারকে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে, যেটা সব বাজার অর্থনীতিতেই হয়ে থাকে। ভালোর জন্যই।
আমেরিকায় বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাব্যবস্থা অত্যন্ত ব্যয়বহুল কিন্তু ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় নিম্নমানের। ইউরোপে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। আরও বেশি বাজারমুখী হওয়া চীনের জন্য উচিত হবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা সরকার মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। অনেকেই চীনের এই ব্যবস্থাকে যুক্তরাজ্যের ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করছেন। সেখানে সরকারি অবকাঠামোর ওপর বেসরকারি ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে। এই ব্যবস্থা ফ্রান্সের সরকারনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থার চেয়ে ভালো কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু কেউ যদি যুক্তরাজ্যীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তাহলে সরকারের ভূমিকাই সব নির্ধারণ করে দেবে। কারণ, সে দেশে স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অতি নগণ্য। দেশটিতে সরকারি খাত বেশ শক্তিশালী। একইভাবে, চীন যদিও উৎপাদনমুখী অর্থনীতি থেকে সেবা খাতভিত্তিক (২০১৩ সালে প্রথম জিডিপিতে সেবা খাত উৎপাদন খাতকে ছাড়িয়ে গেছে) অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে, তাকে এ লক্ষ্যে আরও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে। ইতিমধ্যে বহু শিল্প অতি-উৎপাদনের সমস্যায় ভুগছে। সে কারণে দক্ষ ও নির্ঝঞ্ঝাট কাঠামোগত সংস্কারের জন্য সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
চীনের অবকাঠামোগত সংস্কার আরও একভাবে হচ্ছে: দ্রুত নগরায়ণ। নগরগুলোকে বাসযোগ্য ও পরিবেশগতভাবে সহনীয় রাখতে সরকারের তরফ থেকে গণপরিবহন, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, পার্ক ও কার্যকর অঞ্চল বিভাজন নিশ্চিত করতে হবে।
২০০৮-এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট থেকে একটি গুরুতর শিক্ষা নিতে হবে, সেটা হচ্ছে বাজারগুলো স্বনিয়ন্ত্রিত নয়। সম্পদ ও ঋণের বুদ্বুদের প্রতি এর বিশেষ আকর্ষণ রয়েছে, যেগুলো আবার শেষ পর্যন্ত ধসে পড়ে। আন্তর্জাতিক পুঁজি যখন উল্টো দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে ধাবিত হয়, তখন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এর জন্য সামাজিক ব্যয়ের পরিমাণ বিপুল। নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি আগ্রহের কারণে এ সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। বিষয়টা শুধু উদারনীতিকরণের গতি ও বিন্যাস নয়, অনেকে যা বলে থাকেন, ফলাফলেরও গুরুত্ব রয়েছে। ডিপোজিটের সুদের হারে উদার নীতি গ্রহণ করার কারণে ১৯৮০ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সঞ্চয় ও ঋণসংকট সৃষ্টি হয়। ঋণ প্রদানের সুদের হারে উদার নীতির কারণে আক্রমণাত্মক আচরণ দেখা গেছে, এতে দরিদ্র ভোক্তাদের শোষণ করা হয়েছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এই নিয়ন্ত্রণ শিথিল হওয়ায় প্রবৃদ্ধির হার বাড়েনি, বরং ব্যাংকিং খাত আরও বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
মানুষ আশা করতেই পারে, চীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে হাঁটবে না। এ পথে হেঁটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যাকাশে বিপর্যয় নেমে এসেছে। নেতাদের জন্য হুমকি হচ্ছে, তাঁদের এখন উন্নয়নের স্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। এর জন্য সরকারকে আরও বেশি টাকা তুলতে হবে। বর্তমানে স্থানীয় সরকারের ভূমি বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীলতা অর্থনীতিতে বিকৃতির একটি দিক তুলে ধরেছে, যেটা দুর্নীতিরও বড় একটি ক্ষেত্র। এর চেয়ে কর্তৃপক্ষের উচিত পরিবেশ কর (কার্বন করসহ) আরোপ করে রাজস্ব আয় বাড়ানো। এর সঙ্গে উচিত কর-ব্যবস্থা আরও প্রগতিশীল (আয়করভিত্তিক) করে গড়ে তোলা (ক্যাপিটাল গেইনসহ) ও সম্পদ কর আরোপ করা। তা ছাড়া, রাষ্ট্রের উচিত এসওইর সিংহভাগ শেয়ারের লভ্যাংশের মাধ্যমে তুলে নেওয়া (এর মধ্যে কিছু কিছু ফার্মের ব্যবস্থাপকদের বিনিময়েও হতে পারে)।
প্রশ্ন হচ্ছে, চীন কি তার এই অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে পারবে (বর্তমান গতির চেয়ে একটু কম হলেও) কি না। পুঁজির স্ফীতি ও রপ্তানিতে বিস্তার সত্ত্বেও বৈশ্বিক চাহিদা পড়ে যাওয়া এবং দুর্নীতি মোকাবিলা করে অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে সক্ষম হবে কি না। অন্যান্য দেশে এ রকম ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অর্থনীতি এগোতে পারেনি, পঙ্গু হয়ে পড়েছে।
সফলতার অর্থনীতিটা পরিষ্কার। নগরায়ণ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় অধিকতর ব্যয়। প্রয়োজনীয় অর্থ আসবে কর থেকে। এতে প্রবৃদ্ধি যেমন টেকসই হবে, তেমনই পরিবেশের উন্নতি হবে এবং অসাম্য কমবে। চীনের রাজনীতি এই এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারলে তা চীন ও সারা দুনিয়ার জন্যই মঙ্গলজনক হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত; স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই. স্টিগলিৎস: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।