লাইক, ভিউ ও শেয়ার বনাম প্রতিভা

লাইক, ভিউ, শেয়ারের উন্মাদনা সত্যিকারের প্রতিভার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে
ছবি: সংগৃহীত


কয়েক দিন আগে ফেসবুকে সংস্কৃতি জগতের এক সুপরিচিত তারকার দেওয়া স্ট্যাটাসে অবাক হলাম। তিনি একজন অপেশাদার শিল্পীর ফেসবুকে পোস্ট করা গানে লাইক আর ভিউয়ের হিড়িক দেখে হতাশা প্রকাশ করেছেন। যেহেতু তিনি নিজে সংগীত চর্চা করেন, তাই তিনি কিছুতেই মানতে পারছেন না ‘মানহীন’ এই ধরনের গানের বিস্তার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সস্তা ও মানহীন বিষয়বস্তু নিয়ে ব্যাপক হইচই ইদানীং চোখে পড়ছে। কৌতুকের ছলে কিংবা নিছক মজা করার উদ্দেশ্যে অনেকেই এই ধরনের বিনোদন ছড়িয়ে দেন। কেউবা আবার এই ধরনের পোস্ট শেয়ার দিয়ে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, মুহূর্তেই লাখ লাখ ব্যবহারকারীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এই সব সস্তা বিনোদন, যা অনেক সময়ই নিবেদিতপ্রাণদের মধ্যে হতাশার জন্ম দেয়। প্রশ্ন হলো, কেন এসব মানহীন বিনোদন ছড়িয়ে পড়ছে, জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে? আবার কেনই বা এই সব বিষয়বস্তুর প্রসার দেখে হতাশ হয়ে পড়ছি আমরা?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তৃতি হঠাৎই পাল্টে দিয়েছে অনেক প্রচলিত ধারণা ও চর্চা। দ্রুতই বদলে যাচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা, ভালো-মন্দের সংজ্ঞা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের ধরন, সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ, ধর্মীয় অনুভূতি থেকে শুরু করে অনেক কিছুই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে অনেকের জীবন। এ ছাড়া রয়েছে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল নানা বিনোদন মাধ্যম ও খেলার উপকরণ। জীবনের চাকচিক্যময় এই প্রদর্শনে গভীরতা যতই কম থাকুক না কেন, আমাদের জীবনযাপন কিন্তু এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।

আগে যেখানে গুণগত মানই বিবেচ্য বিষয় হতো, আজ সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই বিবেচিত হচ্ছে বিষয়টির লাইক, শেয়ার, ভিউ আর মন্তব্য। এমনকি ছোট শিশুরাও আজকাল ইউটিউবে কিছু দেখার আগে লাইক আর ভিউয়ের সংখ্যাটি দেখতে ভোলে না।

মনে পড়ে আমাদের শৈশবে রোজ সকালে ঘুম ভাঙত গানের রেওয়াজ শুনে। আশপাশের অনেক বাড়িতে গানের চর্চা হতো। আমাদের ব্যস্ত জীবনে আজকাল সেই সুর আর ভেসে আসে না। কিছুদিন আগেও ভাবতাম হয়তো শিশুদের স্কুলে যাওয়ার তাড়া কিংবা পড়ার চাপ তাদের সংস্কৃতিচর্চা থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু করোনা মহামারিতে বাড়িতে বন্দী দিনগুলোতে এক দিনের জন্যও কানে ভেসে আসেনি কোনো সুর। অথচ ফেসবুকের পাতায় লক্ষ করি, চারদিকে চলছে তারকা হওয়ার তীব্র যুদ্ধ। আছে গান, নাচ, আবৃত্তিসহ নানা কিছুর ভিডিও, ফেসবুক লাইভ, টিকটক, ইউটিউব লিংকসহ প্রতিভা প্রদর্শনের নানা আয়োজন। কেউবা কারাওকে মিউজিকের সঙ্গে গান করছেন আবার কেউবা স্টার মেকারের মতো সফটওয়্যারের বদৌলতে রাতারাতি তারকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এসবের মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যেহেতু কারও মাথাব্যথা নেই, তাই প্রচুর মানহীন বিষয়বস্তু আমাদের সামনে আসছে।
আগে যেখানে গুণগত মানই বিবেচ্য বিষয় হতো, আজ সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই বিবেচিত হচ্ছে বিষয়টির লাইক, শেয়ার, ভিউ আর মন্তব্য। এমনকি ছোট শিশুরাও আজকাল ইউটিউবে কিছু দেখার আগে লাইক আর ভিউয়ের সংখ্যাটি দেখতে ভোলে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁর যতই বেশি ফলোয়ার, তিনি তত বড় তারকা। মিডিয়া বাণিজ্যও এখন লাইক আর ভিউয়ের চক্রে বন্দী। তারকাদের সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশনে আজকাল গুরুত্ব পায় তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা সংবাদের লাইক, ভিউয়ের সংখ্যাগত তথ্যটি। এই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের ব্যক্তিজীবনেও। যার পোস্টে যত বেশি লাইক আর কমেন্ট, তিনি তত বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছেন পরিচিত মহলে। তথাকথিত এই সংজ্ঞায় অগুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত অনেকেই হতাশায় ভুগছেন। এমনকি অনেকে নিজেদের সরিয়ে নিচ্ছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে।

তবে এটিও সত্যি যে এভাবে বেরিয়ে আসছে কিছু প্রতিভা; যদিও সংখ্যাটি একেবারেই নগণ্য। তাই বিষয়টিকে আমি পুরোপুরি নেতিবাচকভাবে দেখতে চাই না। তবে আহত হই তখন, যখন দেখি এই সব কনটেন্টের প্রসার নিয়ে আমাদের যতটুকু মাথাব্যথা, তার সিকি ভাগও নেই বিষয়বস্তুর গুণগত মান নিয়ে। যদি শিল্পের গুণগত মানের বিষয়টিকে সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হতো, তবে শিল্প-সাহিত্যে চরম উৎকর্ষের আরেকটি যুগের সূচনা হতে পারত। অনেকেই আছেন, যাঁরা এই সব মাধ্যমের পূর্ণ ব্যবহার করে দ্রুত তারকাখ্যাতি লাভ করতে চান, অথচ এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সময় ও শ্রম দিতে তাঁরা রাজি নন।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে আজকাল হেলাফেলা করার আর সুযোগ নেই। কারণ, এই সব মাধ্যমে আমরা কীভাবে অংশগ্রহণ করছি, তার মাধ্যমে প্রতিফলিত আমাদের ব্যক্তিত্ব। তাই যেকোনো বিষয়বস্তু ছড়িয়ে দেওয়ার আগে তার সত্যতা এবং গুণগত মান বিবেচনা করার প্রয়োজন নিশ্চয়ই আছে। প্রয়োজন নিজের শিক্ষা ও বিচার-বুদ্ধির সঠিক ব্যবহার। আমরা নিছক মজা করার জন্য যা ছড়িয়ে দিচ্ছি, তা যেন মানহীন এবং অরুচিকর বিষয়বস্তুর প্রসারে সহায়ক না হয়, সেই বিষয়ে চাই দায়িত্বশীল আচরণ। প্রয়োজন আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারার শিক্ষা। সময়টা এখন পুরোনো আর নতুন যোগাযোগমাধ্যম এবং কৌশলের যুগসন্ধিক্ষণের। পাশাপাশি রয়েছে বৈশ্বিক করোনা মহামারির অভূতপূর্ব বাস্তবতা। তাই দ্বন্দ্ব থাকবেই।
ইতিহাস বলে, প্রতিটি যুগসন্ধিক্ষণেই ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, নতুন-পুরানোর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে ইতিবাচক কিছু, যাকে সম্বল করে এগিয়ে যায় সভ্যতা। তাই আশা হারালে চলবে না। জীবন কখনো পেছনের দিকে ধাবিত হয় না। সে তার আপন মহিমায় সামনে এগিয়ে যায়। তাই গুরুত্বপূর্ণ এই সময়টায় ধৈর্য ধরতে হবে, হতাশ হলে চলবে না। চাই উপলব্ধির গভীরতা ও পরিপক্বতা। বড়দের আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, চটকদার আর আপাত রঙিন যা কিছু তা সময়ের গর্ভে বিলীন হবেই। আর যা কিছু শাশ্বত আর সুন্দর তা উদ্ভাসিত হবেই।


নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo. com