লড়াই একদর্শী হিন্দুত্ব বনাম নিখাদ বাঙালিয়ানার

নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

পশ্চিমবঙ্গ দখলে বিজেপি কতটা মরিয়া, তার সবচেয়ে বড় নমুনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অদম্য তাগিদ। স্বাধীন ভারতের প্রথম ভোট হয় ১৯৫২ সালে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রী কোনো রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে মোদির মতো এতবার সফর করেননি। এত জনসভায় ভাষণ দেননি। ইতিমধ্যে তিনি ১২ বার রাজ্য সফর করেছেন। আরও দুবার করবেন। সব মিলিয়ে ভাষণ দেবেন ২২টি জনসভায়। তাঁর দক্ষিণহস্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও পিছিয়ে নেই। যেমন নেই বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎ প্রতাপ নাড্ডাসহ অন্যরা। সবাই মিলে শতাধিক জনসভা ও রোড শো করেছেন। করোনাকালে হুলুস্থুল হাল! স্পষ্টতই প্রমাণিত, পশ্চিমবঙ্গ জয় তাঁদের বড় দায়।

এই দায় দুটি কারণে। প্রথম কারণটি নিতান্তই রাজনৈতিক। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে পাঁচ বছর পর তারা ২৮২ আসন টপকে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল। সফলও হয়। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে পায় ৩০৩টি আসন। তখনই তারা পরবর্তী টার্গেট ঠিক করে ফেলে। ২০২৪ সালে ৩৩৩ আসন পেতে হবে। তা পেতে হলে পশ্চিমবঙ্গ জেতা জরুরি। রাজ্যের ৪২ লোকসভা আসনের সিংহভাগ না পেলে লোকসভার গরিষ্ঠতা রক্ষা কঠিন হতে পারে। এ শঙ্কার কারণ, গুজরাট ছাড়া যে যে রাজ্যে তারা পরীক্ষিত, প্রায় প্রতিটিতেই তাদের সমর্থন কমেছে। সহজ ব্যাখ্যা, বিজেপি যে যে রাজ্যে ‘চ্যালেঞ্জার’, সেসব জায়গায় ভালো ফল করছে। কিন্তু যেখানে ‘ডিফেন্ডার’, সেখানে আশানুরূপ নয়। গুজরাটের মতো বিপরীত ব্যতিক্রম দিল্লি।

পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কায়েম বিজেপির প্রথম লক্ষ্য হলে দ্বিতীয় লক্ষ্য গোটা দেশে তাদের মতাদর্শ দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। সেই মতাদর্শ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-নির্ধারিত, যা কিনা প্রকারান্তরে হিন্দুস্থানকে ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ পরিণত করার শামিল। এ কারণে মোদি-শাহসহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা বারবার বলছেন, নির্বাচনী যুদ্ধে জেতাটাই বড় কথা নয়, আসল কথা মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা, যা এখনো শেষ হয়নি।

সেই লক্ষ্যে বিজেপি কিন্তু দ্রুত এগিয়ে চলেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৯ ছিল তাদের জমি শক্ত করার সময়। দ্বিতীয়বার আরও সংখ্যা নিয়ে জেতার পর বিজেপি তার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার দিকে দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যাচ্ছে। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ অধিকার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করেছে। অযোধ্যায় রামমন্দির প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রচলনে তিন তালাক প্রথা রদ করেছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি) তৈরির উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) পাস করে অভীষ্ট পূরণে এগোচ্ছে। রাজ্যে রাজ্যে নিষিদ্ধ হয়েছে গোহত্যা। চালু হয়েছে ধর্মান্তর রুখতে লাভ জিহাদ আইন।

নিজস্ব মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় নিয়মিত তৈরি হচ্ছে ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’-এর তালিকা। বিজেপিশাসিত রাজ্যে মিড-ডে মিল থেকে আমিষ তুলে দেওয়া হয়েছে। এমনকি, রামনবমী বা নবরাত্রির মতো বিভিন্ন হিন্দু উৎসব-পার্বণের সময় জবরদস্তি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে মাছ-মাংসের দোকান। ইদানীং একটা নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন পুরসভা নিয়ম করেছে, রেস্তোরাঁগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে জানাতে হবে কোন মাংস তারা ব্যবহার করে। ‘হালাল’ না ‘ঝটকা’! দলের প্রতিটি ‘ব্রেন স্টর্মিং সেশন’ বা ‘চিন্তনশিবিরে’ মোদি-শাহ তাই নিয়ম করে বলেন, ‘শুধু ভোটে জেতা ও সরকার গঠন বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য নয়, বিজেপিকে হতে হবে সরকার ও সমাজের সংযোগকারী সেতু। আদর্শ প্রতিষ্ঠার বাহন।’

সংঘাতটা হয়ে উঠেছে যতটা রাজনৈতিক, ততটাই সাংস্কৃতিক। একদিকে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্ব’, অন্যদিকে ‘নিখাদ বাঙালিয়ানা’। একদিকে সর্বগ্রাসী গোবলীয় সংস্কৃতি, অন্যদিকে শ্রীচৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দর ভক্তি ও ভাবধারার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বহুত্ববাদী বাঙালিত্ব।

পশ্চিমবঙ্গ দখল করতে না পারলে সেই লক্ষ্যপূরণ অসম্ভব। সর্বভারতীয় উপস্থিতির জন্য পশ্চিমবঙ্গ দখল তাদের কাছে যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনই জরুরি মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে। এবারের ভোটযুদ্ধ সেই আলোতেই দেখতে হবে।

স্বাধীনতা-উত্তর বঙ্গরাজনীতি ছিল স্পষ্টতই দুই বিপরীত শিবিরে বিভক্ত। একটি কংগ্রেস ঘরানা, অন্যটি কমিউনিস্ট। কংগ্রেসের ভাঙনে মধ্যপন্থী রাজনীতি যেমন বিভাজিত হয়েছে, তেমনই কমিউনিস্ট পার্টিতে একাধিক ভাঙন ধরলেও তা বামপন্থীই থেকেছে। তৃণমূল কংগ্রেস আদর্শগতভাবে কংগ্রেস রাজনীতিরই নামান্তর। তেমনই সিপিআই-সিপিএম-সিপিআইয়ের (এমএল) বিচরণ বাম ও অতি বাম আঙিনায়। এই বিভাজিত দুই মেরুর মধ্যে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি কোনো দিন স্থান করে নিতে পারেনি। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে হিন্দু মহাসভাও পশ্চিমবঙ্গে হাঁটি হাঁটি পা পার বেশি এগোতে পারেনি। এর একটা বড় কারণ দেশভাগের পর মুসলিম লীগের রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা কমে যাওয়া।

দ্বিতীয় কারণ উদ্বাস্তুদের নিয়ে কমিউনিস্ট-বামপন্থীদের অর্থনৈতিক আন্দোলন। ৭০ বছর ধরে এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক চালচিত্র, এই প্রথম যেখানে প্রবলভাবে ধাক্কা দিতে চাইছে বিজেপি। অর্থবল, লোকবল ও সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ হিসেবে যুক্ত হয়েছে মোদি-শাহর ক্ষুরধার নেতৃত্ব, সরকারি আনুগত্য ও অনুগত ‘জো হুজুর’ মিডিয়া। তৃণমূল কংগ্রেসের মতো নিতান্তই রাজ্যভিত্তিক এক আঞ্চলিক দলের পক্ষে বিজেপির এ অপ্রতিরোধ্য রথ থামানো হয়ে দাঁড়িয়েছে অসাম্য এক লড়াইয়ের প্রতীক।

ষাটের দশকে তো অবশ্যই, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতৃত্ব কেন্দ্রের কাছে বেশ খানিকটা গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। পরবর্তী সময়ে বাম ফ্রন্টের নেতাদের প্রতিও দেখা গেছে কেন্দ্রীয় শাসকের একধরনের শ্রদ্ধামিশ্রিত বিরোধিতা। বাঙালিকে ‘বাঙালিয়ানা’ বিসর্জন দিয়ে ‘ভারতীয়’ করে তোলার তাগিদ কংগ্রেস বা পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রের কোনো শাসকই কখনো অনুভব করেননি। সহাবস্থান ও সহনশীলতার আদর্শচ্যুত হননি। বহুত্ববাদ, বৈচিত্র্য ও বিবিধের প্রয়োজনীয়তা বিসর্জন দিয়ে গোটা দেশে একদর্শী মতবাদ প্রতিষ্ঠায় বিজেপির বর্তমান নেতাদের যে তাগিদ, এর বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক লড়াই একধরনের প্রতীকী ব্যঞ্জনা পেয়ে গেছে।

সংঘাতটা হয়ে উঠেছে যতটা রাজনৈতিক, ততটাই সাংস্কৃতিক। একদিকে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্ব’, অন্যদিকে ‘নিখাদ বাঙালিয়ানা’। একদিকে সর্বগ্রাসী গোবলীয় সংস্কৃতি, অন্যদিকে শ্রীচৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দর ভক্তি ও ভাবধারার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বহুত্ববাদী বাঙালিত্ব। উত্তর ভারতীয় একদর্শী মতবাদের আগ্রাসনে এতকালের চেনা বাঙালিয়ানা ভেসে যাবে কি না, বাঙালিকেই তা ঠিক করতে হবে। স্বকীয়তা বজায় রেখে মাথা উঁচু করে বাঁচা, নাকি হিন্দুত্ববাদী প্রভুত্বের কাছে মাথা নোয়ানো? এ ভোট সেই চূড়ান্ত দিক নির্ণয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ।

নির্বাচনী ফল যা-ই হোক, এই ভোট সাঙ্গ হলেও লড়াই কিন্তু শেষ হবে না। বাঙালির স্বকীয়তা গ্রাস করে এ ভূখণ্ডে বিজেপি তার মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই জারি রাখবে। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের মতো ক্ষুদ্র প্রতিযোগিতা ভুলে সচেতন বহুত্ববাদী বাঙালি এই বৃহত্তর সংগ্রামে জোটবদ্ধ হতে পারবে কি? না পারলে ‘সে বড় সুখের সময় নয়/ সে বড় আনন্দের সময় নয়।’

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি