শটগান নেতাদের যুগ এল দেশে?

দেশে এসেছে শটগান নেতাদের যুগ
ছবি: সংগৃহীত

ট্রাম্প–সমর্থকেরা যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলে অস্ত্র নিয়ে ঢুকে অন্যায় করেছেন। এ জন্য তাঁদের বিচার হচ্ছে। উসকানিদাতা হিসেবে ট্রাম্পের বিচারও হতে পারে। তবে যাত্রা এক হলেও বাংলাদেশে তার ফল ভিন্ন হতে পারে। একেই বলে একযাত্রায় বিপরীত ফল।

পাবনায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের কার্যালয়ে শটগান হাতে মহড়া দিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের তিন নেতা। সাধারণত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য পিস্তল বা রিভলবার বহন করা হয়, যদি অস্ত্রধারীর লাইসেন্স থেকে থাকে। কিন্তু এই তিন যোদ্ধার হাতে ছিল শটগান, যা সাধারণত ব্যবহৃত হয় রাস্তার লড়াইয়ে। তাঁদের অস্ত্র হাতে মহড়ার ভিডিও ফুটেজে প্রচারিত হওয়ায় প্রশাসন বলতে পারবে না যে ‘কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়’। গত এপ্রিল মাসে রাজধানীতে যুবলীগ নেতার গুলিতে প্রকাশ্যে রাস্তার ওপর খুন হয়েছেন একজন ঠিকাদার। ঠিকাদারি কাজের ভাগ-বাঁটোয়ারায় অস্ত্রের ভূমিকা এখন প্রায় ‘স্বাভাবিক’ হয়ে গেছে। দেশে এসেছে শটগান নেতাদের যুগ।

তবে এই দৃশ্য যদি বিরোধীদলীয় কারও দ্বারা তৈরি হতো, তাহলে এতক্ষণে তাঁকে চৌদ্দ শিকের ভেতর চালান হতে হতো। কিন্তু যেহেতু তাঁরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা, সেহেতু পাবনার পুলিশ সুপার মুহিবুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমরা তদন্ত করছি। অস্ত্র আইনের শর্ত ভঙ্গ হয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’ পাবনার জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, ‘ঘটনাটি শুনেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিষয়টি তদন্ত করছে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

খতিয়ে দেখা, তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশ ইত্যাদি কথা আসলে একধরনের মারফতি ভাষা। কত গভীরে খতিয়ে দেখা হবে, তদন্তে যা পাওয়া যাবে এবং প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে কী সুপারিশ করা হবে এবং সেই সুপারিশ কাকে বাঁচাবে আর কাকে ফাঁসাবে, কত দিনে তা বাস্তবায়িত হবে, তা যেন করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতোই অনিশ্চিত ব্যাপার।

অথচ এই প্রশাসনই ফেসবুকে সামান্য ক্ষোভ প্রকাশের কারণে কতজনকে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে তড়িঘড়ি করে জেলে ভরে দিল! আইনের গতি সবার জন্য সমান না।

ফৌজদারি ঘটনার বিহিত ফৌজদারি কর্তৃপক্ষ করবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের তো জানতে ইচ্ছা করতে পারে যে দেশে কি নতুন কোনো বাহিনী গঠিত হয়েছে কি না। প্রায়ই দেখা যায়, সরকারদলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র হাতে মহড়া দিচ্ছেন। গত মাসে কুমিল্লার চান্দিনা ও চট্টগ্রামে এ রকম মহড়া দেখা গেছে। যেকোনো বিক্ষোভ দমনে এখন পোশাকধারী বাহিনীর পাশাপাশি সাধারণ পোশাকের লোকজনকে অস্ত্র হাতে দেখা যায়। সম্প্রতি হেফাজতের বিক্ষোভ দমনের সময়েও এমন লোকজন দেখা গেছে। সাধারণ পোশাকে পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে অস্ত্র উঁচানো এই ব্যক্তিরা কোন বাহিনীর সদস্য? নোয়াখালীর বসুরহাটে কাদের মির্জাকেন্দ্রিক ডামাডোলে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে একজন সাংবাদিকের মৃত্যুও ঘটেছিল। অনেক দিন তো হয়ে গেল, এসব অস্ত্রধারীদের কেউ কি ধরা পড়েছে?

না, আইনের গতি সবার জন্য সমান না।

দেশের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো তো আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি সুসজ্জিত ও বেশুমার। এরপরও সরকারি দলের নানা পর্যায়ের লোকজনকে নিজেদের নিরাপত্তায় এত অস্ত্র রাখাতে হয় কেন? আওয়ামী লীগের একটি জেলা কমিটির ‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক’ সম্পাদকের কেন অস্ত্রের নিরাপত্তা লাগবে এবং কেন সেটা প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে সরকারি অফিসে ঢুকতে হবে? কাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারি দলের লোকজনকে এভাবে অস্ত্রের বৈধ বা অবৈধ মালিকানা নিতে হয়?

সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আগে আঙুল বাঁকা করতে হতো; মানে বিভিন্ন কায়দার ফন্দি-ফিকির। চলতি নিয়ম হলো সরাসরি বলপ্রয়োগ। রামদা-পিস্তল-শটগানের ব্যবহার তাই বাড়ছে। শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করছে? মেরে সরিয়ে দাও। না সরলে বাঁশখালীর কায়দায় গুলি করো। কেউ লোভের মিছরিতে হাত দিতে চাইছে? তাকে অস্ত্র দিয়ে ঠেকিয়ে দাও। বলপ্রয়োগের বিস্তার আর বেসরকারি হাতে অস্ত্রের বিস্তার সমানতালেই ছড়াচ্ছে। সাংসদ বনাম উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান বনাম ভাইস চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ বনাম যুবলীগ, যুবলীগ বনাম ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে অস্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে হরহামেশাই।

ছোটখাটো নেতারাও সব সময় ব্যক্তিগত অস্ত্র বহন করছেন। জায়গায় বা বেজায়গায় ঘন ঘন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিতদের আবির্ভাব হচ্ছে। মনোবিজ্ঞানে একে বলে দুর্গ মানসিকতা। দুর্গ মানসিকতা হলো একদল মানুষের সার্বক্ষণিক সন্দেহ আর ভয়ের অবস্থা। কোনো গোষ্ঠী যদি বিশ্বাস করে যে তারা আক্রান্ত হতে পারে, তখন নিজেদের তারা আলাদা করে ফেলে। তাদের মনের মধ্যে কাজ করে যে হয় তুমি আমার পক্ষে নয়তো তুমি শত্রু। চারপাশ নিয়ে তীব্র সন্দেহ ও ভয় তাদের আর বাস্তবতা বুঝতে দেয় না। তারা তখন নিজেদের অতি সুরক্ষিত রাখতে মারমুখী অবস্থানে চলে যায়। নিজেদের চারপাশে সুরক্ষার দেয়াল তোলা শুরু করে। এভাবে দেশের মধ্যে তৈরি হচ্ছে ‘আমরা’ আর ‘ওরা’ নামক বলয়। আগে ছিল ‘আমরা’ বনাম ‘ওরা’। বাংলা সিনেমার আঙ্গু কাবিলা বনাম মাঙ্গু কাবিলা। এখন দেখা যাচ্ছে ‘আমরা’র মধ্যে অনেক ছোট ছোট ‘আমরা’। একদিকে আমাদের আমরা অন্যদিকে আমাদের ওরা।

কেবল অবৈধ অস্ত্র নয় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারও বন্ধ না করা গেলে এই দুর্গ মানসিকতা নিজেই এক বিরাট নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]