শস্যবিমা: সোনার হরিণই থেকে যাবে?

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের পুরো জনগোষ্ঠীর খাদ্য চাহিদা পূরণের মূল ঝুঁকিটি নিতে হয় কৃষককে। কারণ, কৃষি উৎপাদন বিষয়টিই ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। যার সঙ্গে মাটি, পানি ও জলবায়ুর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্ক রয়েছে যত্ন ও পরিচর্যার। সম্পর্ক রয়েছে সঠিক সময়ে সঠিক উপকরণ প্রয়োগের। আবার প্রকৃতির প্রতিটি অংশের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও বীজ রোপণের সময় থেকে শুরু করে ফসল তোলার আগ পর্যন্ত কৃষক নিশ্চিত করে বলতে পারেন না ষোল আনা ফসল ঘরে উঠবে কি না। বিজ্ঞান অগ্রসর হওয়ায় অনেক কিছুই কৃষকের হাতের নাগালে এসেছে, কিন্তু তার পরও ঝুঁকি কমেনি, বরং বেড়েছে।  আর বাংলাদেশের জন্য এই ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা অনেক বেশি প্রযোজ্য। পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলের প্রথমটিই বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের নতুন অভিজ্ঞতা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ সঙ্গে করেই চলে এ দেশের কৃষি।

পরিবেশ, প্রকৃতির পরিবর্তন, জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ও সব ক্ষেত্রে ব্যাপক বাণিজ্যিকায়নের কারণে সনাতন পদ্ধতির কৃষির ওপর আর আস্থা রাখার সুযোগ নেই। সে কারণেই একদিকে চলছে প্রতিটি ফসলের বেশি ফলন নিশ্চিত করার প্রতিযোগিতা, অন্যদিকে চলছে ফসলবৈচিত্র্য ও শস্য বহুমুখীকরণের দৌড়। অর্থাৎ প্রাকৃতিক অনিশ্চয়তার ভেতরেই ফসলবৈচিত্র্য, উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ ও শস্য বহুমুখীকরণের ঝুঁকি কৃষক নিজেই মাথায় নিচ্ছেন। কারণ একটাই। তা হচ্ছে, নিজস্ব খাদ্য চাহিদা পূরণ, আর্থিক সংগতি অর্জন ও সর্বোপরি কৃষির সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। সে কারণে, কৃষক প্রতিনিয়ত পাড়ি দিচ্ছেন কঠিন এক ঝুঁকিপূর্ণ সময়। সবকিছু এড়িয়ে ফসল ঘরে উঠে গেল তো কৃষকের ভাগ্যপ্রসন্ন, আর না উঠল তো কৃষকের ভরাডুবি। এই পরিস্থিতি মেনে কৃষক পথ চলছেন বহুদিন ধরে। কিন্তু দেশের মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণে তাঁদের যে ভাবনা, সে ভাবনা তো রাষ্ট্রের। কৃষক যেখানে রাষ্ট্রের ভাবনাটি ভাবছেন, দায়িত্বটা পালন করছেন, তাহলে তাঁদের ঝুঁকির ভাগ রাষ্ট্র কেন নেবে না?

প্রশ্ন এখানেই। এই চিন্তা থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষিতে ঝুঁকি সামলে উঠতে কৃষকের জন্য বিমার ব্যবস্থা রয়েছে। এ দেশে এই শস্যবিমা ধারণাটি কয়েক বছর আগ পর্যন্ত একেবারেই মূল্যায়িত হয়নি। যত দূর জানা যায়, ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত ‘উন্নয়নশীল দেশের জন্য শস্যবিমা’ শীর্ষক প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ‘শস্যবিমা প্রকল্প’ চালু করে। ১৯৮১ সালের পর প্রকল্পের গতি মন্থর হয়ে যায়। তবে গতি মন্থর হলেও ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তা চালু ছিল। প্রকল্পটি আরও শক্তিশালী করার জন্য ১৯৯৬ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বিভিন্ন সুপারিশের একটি প্রতিবেদন তৈরি করলেও এ ব্যাপারে সরকারের কাছ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় প্রকল্পটি আর চালু হয়নি। পরবর্তী সময়ে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে কৃষকদের জন্য নামমাত্র প্রিমিয়ামে বিমা চালুর সুপারিশ করা হয়। এগুলো তথ্যপত্রে পাওয়া গেলেও শস্যবিমার বাস্তবতা সত্যিকার অর্থে কৃষক কখনো চোখেও দেখেননি।

সত্তরের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত নিয়মিত গ্রামে যাচ্ছি। কৃষকদের সঙ্গে তাঁদের সমস্যা-সংকট নিয়ে কথা হচ্ছে। কথা হচ্ছে তাঁদের ঝুঁকি নিয়ে। কিন্তু কৃষকের ঝুঁকির অংশীদার কেউই হতে চায় না। ২০০৫ সাল থেকে জাতীয় বাজেটের আগে যখন কৃষকের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনার আয়োজন করছি, তখন থেকে কৃষকদের মধ্যে শস্যবিমার ধারণাটি নিয়ে কম-বেশি আলোচনা চালু করেছি। সে সময় থেকে জাতীয় বাজেটের আগে সরকারের কাছে সুপারিশমালা হিসেবে শস্যবিমা বাস্তবায়নের অনুরোধও জানানো হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক তথ্য হচ্ছে, ২০০৯ সালে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কৃষকের জন্য শস্যবিমার এই প্রস্তাবটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। সে সময় থেকেই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে শস্যবিমার বিষয়ে কাজ চলছে বলে খবর পাওয়া যায়। যাই হোক, বিষয়টির একটি ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে বলেও শোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে একেবারে সাম্প্রতিক অগ্রগতি হলো, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জাপান সরকার শস্যবিমা পরীক্ষামূলকভাবে সম্পাদন করার লক্ষ্যে একটি যৌথ তহবিল গঠন করেছে। যার মাধ্যমে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কৃষক ও খামারিদের ফসলের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাবে, বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি থেকে। ওয়েদার ইনডেক্স বেইজড শস্যবিমার পাইলট প্রজেক্টের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্দেশ্যে জাপান ফান্ড ২০ লাখ ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে এডিবি। তারা এই অর্থের তদারকি করবে।

এই প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ করছে চার লাখ ২০ হাজার ডলার। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো কৃষকদের বিমাকরণে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তাঁরা নিরাপদে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হলেও ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ পৃথিবীর বহু দেশে শস্যবিমা অনেক দিন ধরেই চলে আসছে। জানা গেছে, অন্তত ১২ হাজার কৃষক পরিবারকে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার উদ্দেশ্যে প্রকল্পটি তিন বছর সময়সীমার মধ্যে নির্বাচিত জেলাগুলোতে পরীক্ষামূলকভাবে শস্যবিমা কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। প্রচলিত বিমার ক্ষেত্রে চড়া লেনদেনমূল্য এবং দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে গ্রামাঞ্চলে বিমা প্রদান করা কষ্টসাধ্য ও ব্যয়সাপেক্ষ বিবেচনা করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রিমিয়ামের হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। কৃষি ব্যাংক, বহুমুখী (মাল্টিপারপাস) আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং কৃষি সমবায়ের মতো সংগঠনগুলো এই প্রকল্পের সঙ্গে প্রকল্পটির টেকসই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করবে একসঙ্গে।

আবহাওয়া বিষয়ে সঠিক তথ্য আহরণের লক্ষ্যে জাপান এরোস্পেস এজেন্সির সহায়তায় একটি রিমোটচালিত মহাকাশভিত্তিক প্রযুক্তির বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০টি আবহাওয়াকেন্দ্রের উন্নয়ন হবে এবং সরকারি ও আবহাওয়াসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান, বিমাপ্রতিষ্ঠান, কৃষিসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি মিলিয়ে ৪০০ জনকে আবহাওয়া ইনডেক্সভিত্তিক বিমার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে।

হ্রাসকৃত প্রিমিয়াম এবং উন্নত বিতরণব্যবস্থার পাশাপাশি এই বিমা পদ্ধতি কৃষকদের অন্যান্য সুবিধা প্রদান করবে। যেমন শুষ্ক মৌসুমে আয়সহায়তা প্রদান, ঋণসুবিধা, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ কৃষকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ইত্যাদি। কমপক্ষে ছয় হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের জন্য বিমা সম্পর্কে সচেতনতা এবং ঝুঁকিপূর্ণ জলবায়ু প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক সেমিনারের আয়োজন করা হবে। নিয়ন্ত্রণ ও আইনি কাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে যেখানে অপ্রচলিত বিমাপণ্যের সমাবেশ থাকবে। প্রকল্পটি এডিবির সহায়তায় সেকেন্ড ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রজেক্টের (এসসিডিপি) সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। নতুন বিমাপণ্যগুলো ক্ষুদ্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান দ্বারা সরবরাহকৃত ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে কৃষকের উৎপাদিত ফসল হবে মূল্য সংযোজিত।

শস্যবিমা নিয়ে এবারের আয়োজনটি ইতিবাচক, কিন্তু সবকিছুই নির্ভর করছে পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর। আমি ব্যক্তিগতভাবে ও আমার বিভিন্ন টেলিভিশন কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সরকারের কাছে যে বিষয়ে বারবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি তা হচ্ছে, কৃষকের বিনিয়োগকে মূল্যায়ন করতে হবে। বিশেষ করে, বর্তমান সময়ে উচ্চমূল্যের ফল ও ফসল—আম, কুল, লিচু, পেয়ারা, স্ট্রবেরি ও ড্রাগন ফলে কৃষক অনেক বেশি বিনিয়োগ করছে। এই ফলগুলোর আবাদ কৃষককে এক বছরের মধ্যে যেমন ভাগ্য পাল্টে দিচ্ছে, একইভাবে আর্থসামাজিকভাবে পথেও বসার উদাহরণও আছে। এ ক্ষেত্রে যদি বিমার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে কৃষকের একার ওপর ক্ষতির চাপ পড়ত না। স্পষ্টতই আমার মনে হয়, ধান আবাদের ক্ষেত্রে শস্যবিমা এত দ্রুত হয়তো সম্ভব হবে না। তবে যেকোনো উচ্চমূল্যের ফল, ফসল ও কৃষির উপখাতগুলো অনায়াসেই আসতে পারে বিমার আওতায়। যেমন পোলট্রি ও মৎস্য খাত।

এখানেও জলবায়ুগত ও সামাজিক অনেক কারণে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন। শত্রুতামূলকভাবে বিষ দিয়ে কৃষকের পুকুরের মাছ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষক এই ক্ষতি কোনোভাবেই পুষিয়ে উঠতে পারেন না। এই ঝুঁকিতে কেউ মৎস্যচাষির পাশে নেই। আবার দুগ্ধ খামার বা পশু পালনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। এসব ক্ষেত্রে বিমাব্যবস্থা না থাকার কারণে, তৃণমূল পর্যায়ে আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিষয়টি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমার পরামর্শ হচ্ছে, ক. একযোগে বিমাব্যবস্থাটি উচ্চমূল্যের ফল-ফসল আবাদ, পোলট্রি খাত, মৎস্য খাত ও দুগ্ধ খামার খাতের জন্য চালু করতে হবে। খ. এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ব্যাংক বা বিমাপ্রতিষ্ঠানের মাঝামাঝি ঝুঁকির অংশীদার হিসেবে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে হবে। যা কৃষক ও বিমাপ্রতিষ্ঠান—দুয়ের ঝুঁকিকেই ভারসাম্যপূর্ণ করতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। গ. বিমার প্রিমিয়াম নামমাত্র ধার্য করতে হবে। ঘ. বিমা কার্যক্রম চালুর আগে অবশ্যই কৃষকের স্তর (বড়, মাঝারি, ক্ষুদ্র, ভূমিহীন, বর্গাচাষি) নিরূপণ করে নিতে হবে। সবকিছু নির্ভর করছে কার্যকর বাস্তবায়ন, কৃষকের চাহিদা ও দাবি মূল্যায়নের ওপর। সব মিলিয়ে সরকারের গ্রহণ করা নতুন প্রকল্প সম্পর্কে বিশ্বব্যাংকের মন্তব্যটি বেশ ইতিবাচক। তারা বলেছে, বাংলাদেশে কৃষিবিমা চালু হলেও তা এমনভাবেই হওয়া উচিত যাতে করে প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষকেরা এর সুফল ভোগ করতে পারেন।

শাইখ সিরাজ: পরিচালক ও বার্তা প্রধান, চ্যানেল আই।