শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিন

নিরাপদ সড়কের দাবিতে যেসব শিক্ষার্থী মাঠে নেমেছিল এবং তারও আগে যাঁরা কোটা সংস্কার আন্দোলন করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আন্দোলনে যুক্ত থাকার দায়ে গত বুধবার পর্যন্ত ৯৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৫১টি। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে উভয় আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে অভিহিত করা হয়েছিল। যৌক্তিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারের এই অযৌক্তিক গ্রেপ্তার অভিযান নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যাঁরা আন্দোলনের সময় উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন কিংবা গুজব ছড়িয়েছেন, কেবল তাঁদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। এঁদের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শহিদুল আলমও আছেন। তিনি কোনো গুজব ছড়িয়েছেন, সে রকম তথ্য–প্রমাণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দিতে পারেননি। একটি বিদেশি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি সরকারের সমালোচনা করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের সমালোচনা বা কাজের বিরোধিতা করা অপরাধ নয়।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, সরকার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাঙ্গনের বাইরের একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করলেও আন্দোলনকারীদের ওপর যাঁরা বিভিন্ন সময়ে হামলা চালিয়েছেন, তাঁদের কাউকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়নি। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুবসংগঠনের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। রাজশাহীতে ছাত্রলীগের কর্মীরা এক শিক্ষার্থীর পা হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও শহীদ মিনারে আন্দোলনকারীদের ওপরও তঁারা দফায় দফায় হামলা চালিয়েছেন। এসব হামলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কারও কারও নাম–পরিচয় গণমাধ্যমে এলেও পুলিশ তাঁদের খুঁজে পাচ্ছে না। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। 

এ ছাড়া নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই আন্দোলনের খবর সংগ্রহ করতে গিয়েও প্রথম আলোসহ অনেক গণমাধ্যমের সাংবাদিক আহত হয়েছেন। শিক্ষার্থীরা তাঁদের ওপর হামলা করেনি। সরকার-সমর্থক ছাত্র ও যুবসংগঠনের কর্মী-সমর্থকেরা এই হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তাঁদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেও দেখা গেছে। সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী যে-ই হোক, ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সরকারের মন্ত্রী-নেতারা বুলন্দ আওয়াজ তুললেও এখনো পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। উল্টো পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সাংবাদিকেরাও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীরা যদি গ্রেপ্তার না হন, তাহলে বোঝা যাবে সরকারের কথা ও কাজে মিল নেই। ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও হামলার নিন্দা করেছে।

আটক আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকার গুজব ছড়ানো ও উসকানি দেওয়ার অভিযোগ এনেছে। সত্যি সত্যি যদি কেউ গুজব ছড়িয়ে থাকে, প্রচলিত আইনে তাঁর বিচার হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্দেহের বশে সিরাজগঞ্জের চর থেকে একজন নারী শিক্ষার্থীকে ধরে আনতে পারলেও ঢাকায় সাংবাদিক পীড়নকারীদের খুঁজে পায় না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই স্ববিরোধী অবস্থান আইনের শাসনের পরিপন্থী।

সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে যৌক্তিক বলে অভিহিত করা হয়েছে। যৌক্তিক আন্দোলনকে কখনোই বল প্রয়োগের মাধ্যমে সমাপ্তি টানা যাবে না। কোটা সংস্কার কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যদি কেউ অনুপ্রবেশ করে বিশৃঙ্খলা ঘটিয়ে থাকে, তাহলে সরকারের উচিত হবে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা তথ্য–প্রমাণ ছাড়া শিক্ষার্থী কিংবা শিক্ষাঙ্গনের বাইরের কাউকে অযথা হয়রানি অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। 

শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের স্বার্থে অবিলম্বে আটক সব শিক্ষার্থীর মুক্তি দিন।