শিক্ষায় পরিবর্তনে যে ঝুঁকি বাড়তে পারে

চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষার্থীর স্বপ্ন যেমন ধ্বংস হয়, তেমনি সমাজ হারায় মেধাবীদের।ছবি: প্রথম আলো

ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরে যে বিদ্যালয়ে প্রথম ভর্তি হই, তার নাম ছিল ‘...বহুমুখী বিদ্যালয়’। প্রথম দিনই ক্লাস শেষ করে বাইরে এসে খুঁজতে থাকি বিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারের সংখ্যা। একটি মাত্র প্রবেশদ্বার, কিন্তু নাম বহুমুখী—এই নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে সে কী তর্ক! কেন এমন নাম, ‘মুখ তো মাত্র একটা’ ইত্যাদি।

যাক, পরবর্তী সময়ে বুঝতে পারলাম ‘বহুমুখীর’ মানে। দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা এখনো বহুমুখী, অর্থাৎ বহুধাবিভক্ত। বোধ করি, ঔপনিবেশিক ধারার যৎসামান্য পরিবর্তন হয়েছে, বেড়েছে বিভিন্ন মাধ্যমের বহুমুখিতা। তারপরও তৈরি হচ্ছে না যুগোপযোগী ও দক্ষ মানবসম্পদ।

সম্প্রতি দৈনিক পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। শিক্ষামন্ত্রীও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষাব্যবস্থায় বড় পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন। যদিও পেশাগত কারণে উচ্চশিক্ষার বিষয়ে আমার কিছুটা জ্ঞান রয়েছে, তবে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা তুলনামূলকভাবে অপ্রতুল। তারপরও শিক্ষাক্রমের প্রস্তাবিত পরিবর্তন নিয়ে বেশ কিছুদিন পড়ালেখা করে একটা ধারণা নিলাম।

একদিকে প্রস্তাবিত পদ্ধতিটি যেমন যুগান্তকারী, অন্যদিকে তেমনি হতাশার। যুগান্তকারী, কারণ প্রস্তাবিত ব্যবস্থায় দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোনো বিভাজন থাকবে না, কমবে পাবলিক পরীক্ষার চাপ। হতাশার কারণ, প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে পছন্দ না হলেও সবাইকে সব বিষয় পড়তে হবে। থাকবে না কোনো ঐচ্ছিক বিষয়। সমস্যাটা এখানেই।

আমার সময়েও (আশির দশকে) বিষয় নির্বাচনের সুযোগ ছিল। ২০২০ সালে যেখানে বিষয় নির্বাচনের পরিধি বাড়ার কথা, সেখানে এই সুযোগই নেই! বিজ্ঞান ও গণিতের বিভাজন, যেমন বৈকল্পিক গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা থাকা বাঞ্ছনীয়। তা না হলে শিক্ষা হবে একপেশে, ভালো না লাগলেও পড়তে হবে শুধু সনদপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে।

একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমার এক পরিচিত লোকের মা-বাবার খুব শখ ছিল ছেলে ডাক্তার হবে, কিন্তু ছেলের শখ রসায়নে পড়বে। অনেকটা জোর করেই ছেলেকে মেডিকেল কলেজে ভর্তির এক বছর পর সে পড়ালেখাই ছেড়ে দিল। অনেক জোরাজুরির পর কোনোমতে ডিগ্রি পড়ে শিক্ষাজীবনের ইতি। শেষতক মা–বাবার শখ তো পূর্ণ হলোই না, উপরন্তু ছেলেটার জীবনই লন্ডভন্ড হয়ে গেল। মানে, চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত সাধারণত ভালো হয় না। এমন উদাহরণ সমাজে হয়তো এখনো আছে। এতে শিক্ষার্থীর স্বপ্ন যেমন ধ্বংস হয়, তেমনি সমাজ হারায় মেধাবীদের। তাই প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার আশঙ্কাই বেশি, কেননা ওই পদ্ধতিতে তেল ও ঘির মূল্য সমান বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

যত দূর জানা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বিভিন্ন দেশের শিক্ষাক্রম পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও দেশের শিক্ষাবিদদের মতামতের ভিত্তিতে পরিবর্তন প্রস্তাব করেছে। এখন কথা হচ্ছে, এনসিটিবি কোন কোন দেশের শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করেছে? পৃথিবীতে প্রায় সব উন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষাক্রমে (হোক প্রাথমিক, মাধ্যমিক বা উচ্চশিক্ষা) বিষয় নির্বাচনের সুযোগ রয়েছে এবং বহু দেশেই উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত কোনো বিভাজন নেই।

স্কুলশিক্ষায় পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে জাপান। সেখানে প্রায় বছর দু-তিন পরপর শিক্ষার্থী/অভিভাবক ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে ব্যাপক আলাপচারিতার মাধ্যমে জানতে চায় শিক্ষাব্যবস্থার কোথায় উন্নতির প্রয়োজন। শিক্ষাক্রমেও তাঁদের চিন্তাচেতনা, ইচ্ছা–অনিচ্ছার প্রতিফলন থাকে। আবার গণিত ও বিজ্ঞানে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ইতালি, চাইনিজ, জাপানিজ শিক্ষার্থীদের তুলনা দুষ্কর। কামারের কাজ যেমন কুমার দিয়ে হয় না, তেমনি বিজ্ঞান ও গণিতের দুর্বলতা অন্য কিছু দিয়ে পোষানো যায় না। আজকের বিশ্বে মানবসভ্যতার অভাবনীয় উন্নতির পেছনে বিজ্ঞানের অবদান সবচেয়ে বেশি।

প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রম দেখে আমার শ্রীলঙ্কা ও উগান্ডার পিএইচডি ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলাম তাঁদের শিক্ষাক্রম ও বিষয় নির্বাচনের সুবিধা সম্পর্কে। যা জানলাম, তাতে চক্ষু চড়কগাছ! তাঁদের শিক্ষাক্রমের ধারাবাহিকতা ও পরীক্ষা মূল্যায়নের পদ্ধতি উন্নত দেশের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আর শিক্ষার মান বোঝা যায় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তাঁদের কাজ দেখে। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাক্রমে অষ্টম শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীদের তৈরির কাজ শুরু হয় একটু একটু করে। যত ওপরের দিকে যায় গণিত ও বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণার জোর বাড়ে। এতে শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের যৌক্তিক চিন্তার পরিধি বাড়ে, মেধার বিকাশও ঘটে। অন্যদিকে, উচ্চমাধ্যমিক শেষে শিক্ষার্থী নিজের পছন্দমতো (কলা, বিজ্ঞান বা বাণিজ্য) উচ্চশিক্ষা নিতে পারেন।

কখনো কি চিন্তা করেছেন, লিওনেল মেসি কেন ইউরোপিয়া লিগে খেলেন? আর্জেন্টিনায় কি তাহলে ফুটবল খেলা নেই? ব্যাপারটা আসলে তা নয়। যোগ্যতা ও দক্ষতার কারণেই মেসি ইউরোপিয়ান লিগে খেলেন। দিন যত যাচ্ছে, পৃথিবীতে সবকিছুই কঠিন হয়ে আসছে। এক প্রজন্ম আগে কম্পিউটার না জানলেও চলত, কিন্তু এখন সব ক্ষেত্রে কম্পিউটার জানা জরুরি। মানে বর্তমানের মতো ভবিষ্যতেও ডারউইনের ‘বেঁচে থাকার উপযুক্ততমতা’ বিবর্তনমূলক তত্ত্ব বেশি কার্যকর থাকবে, যেখানে মেধা ও যোগ্যতাই হবে বাঁচার একমাত্র হাতিয়ার। আর এই হাতিয়ার তৈরির সর্বোত্তম পন্থা শিক্ষা।

আশরাফ দেওয়ান অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেসের শিক্ষক