শিক্ষায়তনিক ‘চৌর্যবৃত্তি’: কী হয় আর কী করা উচিত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারপ্রথম আলো

মাঝেমধ্যেই আমাদের গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসুদপায় অবলম্বনের ঘটনা তথা ‘চৌর্যবৃত্তি’ নিয়ে খবর ছাপা হয়। দুই–তিন দিন ধরে দেশের দৈনিক এবং সামাজিক মাধ্যমে আবারও এমন একটা খবর ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রথমেই দেখা যাক শিক্ষায়তনিক অখণ্ডতা কী, চৌর্যবৃত্তির সংজ্ঞা, বিষয়গুলোর বৈশ্বিক চর্চা এবং বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট।
শিক্ষায়তনিক সততাকে ইংরেজিতে বলে academic integrity। তা ভঙ্গ করে কেউ যখন অন্য কোনো লেখকের–গবেষকের প্রকাশিত লেখা বা তার অংশবিশেষ ওই লেখককে বা প্রকাশনাকে উল্লেখ না করে নিজের নামে ছাপেন বা নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান বলে দাবি করেন (প্রকাশনার মাধ্যমে), তখন এই কাজটাকে শিক্ষায়তনিক অসদাচরণ বলে। সহজ বাংলায় যা 'চৌর্যবৃত্তি' (plagiarism)।

উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষায়তনিক অসদুপায় অবলম্বন গুরুতর অপরাধ। কেউ যাতে এই অপরাধ না করে, সে জন্য নতুন কেউ (ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক বা গবেষক) বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পরপরই এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়। প্রতিটি বিভাগে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তাঁরা বিষয়টির ওপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। সাধারণত প্রতি তিন বছর পর নতুন করে আবার প্রশিক্ষণ নিতে হয়, নতুন কোনো ইস্যু এলে তাকে কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে এই ব্যাপারে বিশেষায়িত নীতিমালা, যা শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও গবেষকদের জন্য জানা অত্যাবশক।

ইন্টারনেটের কারণে এখন নতুন একটা ধারা যুক্ত হয়েছে, যাকে বলা হয় ‘চুক্তিভিত্তিক প্রতারণা’ বা কন্ট্রাক্ট চিটিং। চুক্তিভিত্তিক প্রতারণা হচ্ছে নিজের কাজ টাকার বিনিময়ে অন্যকে দিয়ে করানো। অবস্থাভেদে আরও অনেক ধরনের শিক্ষায়তনিক অসদুপায় দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের বেলায় অ্যাসাইনমেন্ট বা মার্ক/গ্রেড সংশ্লিষ্ট যেকোনো বিষয়ে অসুদপায় অবলম্বন ভীষণ অপরাধ। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, কোনো কোর্স শিক্ষক ছাত্রছাত্রীর জমা দেওয়া কাজকে প্রথমেই অভিযুক্ত করতে পারেন না, অসুদপায় হয়েছে কি না, প্রমাণের জন্য অনেকগুলো ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথমেই কোর্স শিক্ষক ছাত্রছাত্রীর নামে বিভাগীয় প্রধানকে অবহিত করেন। বলা বাহুল্য, অভিযোগের বিষয়, কারণ, অভিযুক্ত ব্যক্তি সম্পর্কে দালিলিক প্রমাণ এবং এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অন্য শিক্ষার্থীরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিতে কী প্রভাব পড়বে ইত্যাদি লিখিতভাবে জমা দিতে হয়। এরপর বিভাগীয় প্রধান একজন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। তদন্ত কর্মকর্তার প্রথম কাজটি হচ্ছে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগটি জানানো এবং এক সপ্তাহ লিখিত উত্তরের অপেক্ষা করা। মানে অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া। অভিযুক্ত শিক্ষার্থী সশরীরে উপস্থিত হয়েও নিজের পক্ষে কথা বলতে পারেন; সে ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তা বিভাগের তৃতীয় কাউকে উপস্থিত রেখে অভিযুক্তের কথা শুনবেন ও তা লিপিবদ্ধ করবেন।

এই প্রক্রিয়ার পর তদন্ত কর্মকর্তা কোর্স শিক্ষকের জমা দেওয়া প্রমাণাদি, অভিযুক্তের বক্তব্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন জমা দেবেন বিভাগীয় প্রধানকে; তিনি সবকিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে শিক্ষার্থী–সংক্রান্ত ডিসিপ্লিনারি কমিটিকে পাঠিয়ে দেবেন। এই কমিটি অভিযুক্তের বা তাঁর প্রতিনিধির বক্তব্য আবার শুনে চূড়ান্ত রায় দেবে । এ অভিযুক্ত ব্যক্তি সন্তুষ্ট না হলে আপিল করতে পারেন।

এটা শিক্ষার্থীদের বিষয়ে নিয়ম। শিক্ষক বা গবেষকদের ক্ষেত্রে কী নিয়ম? প্রথম নিয়ম হচ্ছে শিক্ষক–গবেষকেরা শিক্ষার্থীদের জন্য রোলমডেল, তাই তাঁদের শিক্ষায়তনিক অখণ্ডতা অত্যাবশ্যক। সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও নিয়মনীতি এবং সম্ভাব্য সামাজিক প্রভাব কী হতে পারে, এগুলো বিবেচনায় রেখে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে শিক্ষক–গবেষকদের বিচারের আওতায় আনার নজিরও বিশ্বে রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে শাস্তির মাত্রা নির্ধারিত হয়, আর শুধু অভিযুক্তকেই ফলাফল জানানো হয়। কোনোভাবেই অভিযুক্ত ব্যক্তি/ব্যক্তিদের নাম কারও কাছে প্রকাশ না করা।

আমাদের দেশে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রকাশনায় অসদুপায় অবলম্বন করলে অভিযোগ সাপেক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে একটা কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ সম্পর্কিত নীতিমালা নেই বা থাকলেও অনেকটা কাগজে–কলমে, সেখানে কোনো ব্যক্তি অভিযুক্ত হবেন কি না, শাস্তির মাত্রা কী হবে, সবকিছু নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। যেমন অভিযুক্তের দলীয় সংশ্লিষ্টতা, কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্ক, ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ইত্যাদি। ফলে কারও ওপর নেমে আসে খড়্গ আবার কেউ পান আনুকূল্য ও অনুকম্পা। সফটওয়্যারের কল্যাণে এখন শিক্ষায়তনিক অসদুপায় বের করা অনেক সহজ। এই সুযোগে আমাদের অনেকেই একে অপরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন। যদি অভিযোগকারী প্রশাসনের/কমিটির পছন্দের বা কাছের ব্যক্তি হন, তাহলে অভিযুক্তের বেশ দুর্ভোগ হয়।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়েগুলোতে চৌর্যবৃত্তির ঘটনায় অনেকেই আশ্চর্য হয়, ধিক্কার জানায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে। অভিযুক্ত ব্যক্তির ছবি–নামধামসহ পত্রিকায় প্রকাশ, যা সামাজিক যোগাযোগে হয় হাসির খোরাক আর পায় কুরুচিকর মন্তব্য, যা কিনা ওই ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে। কিন্তু একজন শিক্ষক যদি অভিযুক্ত হন, এতে তাঁর পরিবার কেন সামাজিকভাবে বিপদাপন্ন হবে। প্রতিষ্ঠানের পদ্ধতিগত ত্রুটি বা নিয়মনীতির অভাবের সব দায়ভার তো অভিযুক্তের ওপর চাপানো যায় না। অভিযুক্ত ব্যক্তি রাজনীতির শিকারও হতে পারেন।

কেন শিক্ষকেরা চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিচ্ছেন? কেনই-বা কেউ কেউ চৌর্যবৃত্তি করেও পদোন্নতিসহ সব সুবিধা ভোগ করছেন, আর গুটিকয় হচ্ছেন আক্রোশের শিকার? প্রচলিত আইন কি শুধু ব্যক্তিবিশেষের জন্য নির্ধারিত? রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? নাকি কারও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তা ব্যবহৃত হচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি একজন শিক্ষার্থী কী করলে চৌর্যবৃত্তি হবে না, তার শিক্ষা না পায়, তাহলে জানবে কীভাবে, শিখবে কোথায়। শিক্ষকদের যদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে জানবে কীভাবে? এমন অবস্থা কিন্তু দেশের শিক্ষক সমাজ তথা উচ্চশিক্ষার জন্য অশনিসংকেত। কিছুদিন পরপর শিক্ষকদের 'চৌর্যবৃত্তির' বিজ্ঞাপন যেভাবে জাতীয় দৈনিক এবং সামাজিক যোগাযোগে প্রকাশ হয়, তাতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটা কথা মনে পড়ে, ‘আমরা সবাই পাপী, আপন বাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি'।

*আশরাফ দেওয়ান: অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্ল্যানেটারি সায়েন্সেসের শিক্ষক