শুধু এক 'মিলি'!

কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর বহিশ্চর্ম থেকে উৎপাদিত বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে গজিয়ে ওঠা বেলনাকার যবক্ষারজাতীয় রঙিন সূক্ষ্ম সূত্রবৎ পদার্থবিশেষ।
এটা অনেকটা কুইজের প্রশ্নের মতো। উত্তরটা ভাবতে থাকুন, আমি আমার গল্প বলি।
সেই উনিশ শ সাতাত্তর সালের ঘটনা। পাবলিক লাইব্রেরিতে কী যেন একটা মেলা বসেছিল। সম্ভবত বাণিজ্য মেলাই হবে। শিরীন আর আমি মেলা দেখে ফিরছি। রাত তখন প্রায় নয়টা। রিকশায় উঠতে যাব, পেছন থেকে নারী কণ্ঠে চিৎকার:
হায়াত ভাই, হায়াত ভাই!
দাঁড়ালাম দুজনে। এক তরুণী ছুটে কাছে এল। সালাম জানিয়ে সরাসরি প্রশ্নে চলে এল সে। আমার স্ত্রীর দিকে তাকাল মনে হলো না।
‘হায়াত ভাই, কাল রাতে নাটকে যে আপনার মাথাভর্তি চুল দেখলাম, সেটা কি আসল? নাকি এই এখনকার মাথাটা আসল? কোনটা উইগ? বলবেন প্লিজ!’
আমার হাত ধরে ফেলেছে ততক্ষণে তরুণী। আমি একটু বিব্রত। শিরীনের দিকে তাকালাম। সে অভিব্যক্তিহীন দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখছে।
হ্যাঁ, আগের রাতে আমার একটি নাটক বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছে, যাতে আমি পরচুলা লাগিয়ে নায়ক চরিত্রে অভিনয় করেছি।
‘বলেন না, প্লিজ!’ হাতে একটু ঝাঁকুনি খেলাম।
‘জি, এটাই আসল। এখন যা দেখছেন।’ উত্তর করলাম আমি।
ভীষণ খুশিতে যেন নেচে উঠল মেয়েটি।
‘প্লিজ, আপনি কখনো উইগ পরবেন না। আপনাকে এমনিতে দারুণ কিউট লাগে।’
আর একটু হলেই বোধ হয় থুতনি ধরে নাড়া দিত মেয়েটি। ভাগ্যিস, দেয়নি।
আমার অবস্থা বোঝানোর প্রয়োজন নেই। স্ত্রীর দিকে আড়চোখে তাকালাম আবার। সে তখনো অভিব্যক্তিহীন।
‘আসি।’ বলেই ঝটিকায় প্রস্থানোদ্যত মেয়েটি আবার ফিরে আসে, ‘ভাবি নাকি? স্লামালেকুম, ভাবি!’
বলেই দৌড়।
এবার পাঠককুল নিশ্চয় অনুধাবন করছেন ওপরের কুইজটি একটি সংজ্ঞা। ওই সূক্ষ্ম সূত্রবৎ পদার্থটি আর কিছু নয়—চুল। Hair!
চুলের অবতারণা কেন হলো, সেটাও নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। এই বস্তুটি এখন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে এটা গুরুত্ব হারিয়েছিল ওপরে বর্ণিত ওই ঘটনার পর। তখন থেকেই ভাবতাম, বাকি চুলগুলোও ত্বরিত অন্তর্ধান করুক, যাতে আমিও দ্রুততম গতিতে আরও ‘কিউট’ হয়ে উঠতে পারি। বিধাতা আমার প্রার্থনা মঞ্জুর যে করেছেন, তার সাক্ষী তো আপনারাই।
মাফ করবেন, নিজের কথাই বলা হচ্ছে শুধু।
এবার কবির কথা বলি তাহলে। চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,/ মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;
কবিকণ্ঠে এমন প্রশস্তি শুনে খুবই স্বাভাবিক কারণে নারীকুল চুল নিয়ে ব্যাকুল হবেন, তাতে আর সন্দেহ কী? তা হোন। হেয়ারস্টাইল ওয়ালাদেরও তো দুটো রোজগার প্রয়োজন। আমরা ততক্ষণে একটু চুলচেরা বিশ্লেষণে যাওয়ার চেষ্টা করি না কেন?
শিক্ষাগত কারণে আমার বহু দিনের পেশা ছিল প্রকৌশল। সেই দৃষ্টিতেই বিশ্লেষণ করি—একটি অর্ধেক জলভর্তি গ্লাস দেখে মানুষের প্রকাশভঙ্গি কেমন হয়, আপনি নিশ্চয়ই জানেন।
নৈরাশ্যবাদী বলবেন—অর্ধেক খালি। আশাবাদী বলবেন—অর্ধেক পূর্ণ। একজন প্রকৌশলী বলবেন— পানির ঘনফলের তুলনায় গ্লাসটা বড়।
দেশের দুই জনপ্রিয় নেত্রীর বাগ্যুদ্ধকে আমি এই দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখতে চাই। আমি বলব, তাঁরা ক্রমেই বাকপটু হয়ে উঠছেন, তাঁদের এ পটুত্ব আমাদের আতঙ্কিত না করে আনন্দিত করছে—এবং বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতে আরও আনন্দ তাঁরা আমাদের দেবেন।
প্রকৌশলী হিসেবে একটা কারিগরি বিশ্লেষণও করা যেতে পারে। এক ইঞ্চিকে আট ভাগ করলে আমরা বলি ১/৮ অংশ, মিস্ত্রিদের ভাষায় এক সুতা। আমরাও চিরদিন মিস্ত্রিদের সঙ্গে এ ভাষাতেই বলেছি। এখন ওই যে সংজ্ঞাতে ফিরে গেলে দেখব, চুল হচ্ছে সূত্রবৎ বস্তু। তাহলে ধরে নিতে পারি, একচুল অর্থাৎ এক সুতা অর্থাৎ এক ইঞ্চির এক-অষ্টমাংশ।
কিন্তু এখন তো আমাদের কারবার ‘মিলি’ নিয়ে অর্থাৎ হাজার ভাগের এক ভাগ নিয়ে। এক ‘মিলি’ এদিক-ওদিক মানে অনেক কিছু। যদিও একচুল মানে প্রকৃতপক্ষে ‘লেশমাত্র’। লেশমাত্রকেও হাজার ভাগ করতে পারা যায়—সেই লেশমাত্রের এক মিলি সরলে যদি ঝড় বন্ধ করা যায়, সেটা কি মঙ্গলজনক নয়?
ঝড়ে চুল উড়বে। হ্যাঁ, উড়বে। তবে শুধু প্রতিপক্ষের নয়। নিজেরও উড়বে। নিরীহ জনগণের চুলও উড়ে গিয়ে যে সৌন্দর্য (কিউট!) বেরিয়ে পড়বে, তা কারও কাম্য নয়। জনগণ অসুন্দরই থাকতে চায়। স্বস্তির অসুন্দর। শান্তির অসুন্দর।
আমার বর্তমান পেশা— অভিনয়। আমি একজন অভিনেতা। সেই হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, অভিনয়ের শেষ কথা বলে কিছু নেই। আর এটাও বিশ্বাস করি যে রাজনীতিবিদদের চেয়ে কুশলী অভিনেতা আর কেউ নয় এবং রাজনীতিতেও শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস—কোনো ঝড় উঠবে না। কারও চুলও উড়বে না।
শুধু এক ‘মিলি’, ব্যস।
হঠাৎ বারান্দায় গিয়ে দেখি আমার নীপবন ফুলে ভরা। বছরের শেষ কদম ফুল। শুভলক্ষণ।
আমার আশা পূরণ হবেই!
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।