শুধু কোটা নয়, সংস্কার প্রয়োজন পুরো প্রক্রিয়ার

অস্বীকার করার উপায় নেই, মেধাবী শিক্ষার্থীরা এখন আর আগের মতো সরকারি চাকরিতে যান না, অনেকে তো বিসিএস পরীক্ষাই দেন না। কোটার বাহুল্য এর অন্যতম কারণ; কিন্তু বিসিএস পরীক্ষার পুরো প্রক্রিয়াটিতে প্রচুর গলদ রয়েছে, যা অনেক মেধাবীকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণেই অনিচ্ছুক করে তোলে—সরকারি চাকরি করা তো দূরের কথা! সুতরাং শুধু কোটার সংস্কার করা হলেই সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আসা বেড়ে যাবে, এমনটি ভাবা ভুল হবে। সংস্কার করতে হবে পরীক্ষাপদ্ধতির প্রথম থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত।
কোটাপদ্ধতিতে এখন ৫৫ ভাগ শিক্ষার্থী সরকারি চাকরি পাচ্ছে। যদিও সংবিধান অনুসারে প্রজাতন্ত্রের সব চাকরিতে সবার প্রবেশের সমসুযোগ রয়েছে; কিন্তু অনুন্নত, প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী কিংবা দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য কিছু বিশেষ সুযোগ রাখাটা স্বাভাবিক। অনেক দেশে সীমিত পরিসরে কোটা রয়েছে, তবে সম্ভবত মেধার চেয়ে কোটার বাহুল্য এ দেশেই রয়েছে। কোন হিসাবে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের কোটায়, ১০ জন নারী কিংবা ১০ জন জেলা কোটায় বা পাঁচজন আদিবাসী কোটায় চাকরি পাবেন? সংবিধানে কি এ রকম কোনো নির্দেশ আছে? কোটা বরাদ্দের আগে চাহিদার হিসাব-নিকাশ বা গবেষণা ছাড়াই সরকারের ইচ্ছানুযায়ী নির্বাহী আদেশে এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, যার বাস্তবায়ন চলছে বছরের পর বছর।
কোটাপদ্ধতি নিয়ে আন্দোলনের এ সময়ে যাঁরা ১০ বা ২০ শতাংশ কোটার কথা বলছেন, তাঁরাই বা কোন হিসাবে এ হার ঠিক করছেন? ধারণাগত অবস্থান থেকে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া অযৌক্তিক; কিন্তু তা-ই হচ্ছে এ দেশে। অনেক সময় কোটা পূরণ না হওয়ায় পদ খালি থাকছে। সে ক্ষেত্রে যেসব কোটায় পদ খালি থাকছে, সেগুলোয় কোটা কমিয়ে দেওয়াটাই সমাধান। কিংবা খালি পদে যাতে মেধার ভিত্তিতে নেওয়া যায়, পিএসসির আইন সেভাবে সংস্কার করা প্রয়োজন ছিল। কোটা সংস্কারের দাবিটি আজকের নয়; ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে কোটার হার ধীরে ধীরে কমিয়ে ১৯৯৭ সালে বিলুপ্ত করার প্রস্তাব এসেছিল সেই ১৯৭৭ সালে। অর্থাৎ কোটা সংস্কারের যে চিন্তা করা হয়েছিল প্রায় ৩৫ বছর আগে, আমাদের শিক্ষার্থীদের এখন আন্দোলন করতে হচ্ছে সেটি বাস্তবায়নের জন্য। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে! অবশ্য আমরা এমনই। স্বাধীনতার পরপরই গঠিত ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন যেসব সুপারিশ করেছিল, আমরা সেগুলোর একটি বড় অংশ বাস্তবায়ন শুরু করেছি ২০১০ সালের পর থেকে। সম্ভবত ৩০-৪০ বছর না গেলে ভালো চিন্তা বাস্তবায়ন করতে আমরা অপারগ!
বিসিএস পরীক্ষায় এখন শুধু দুটি কোটা থাকা উচিত—আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী কোটা। মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। দুস্থ কিংবা অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের সার্বিক দায়দায়িত্ব রাষ্ট্রের বহন করা উচিত। শুধু বিসিএসে কোটা বা এ রকম দু-একটা সুযোগ দিয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ হয় না। জেলা কোটা এ সময়ে অর্থহীন। নারীরা সার্বিকভাবে পিছিয়ে থাকলেও যে পরিমাণ পদ খালি থাকে, তার তুলনায় যোগ্য, শিক্ষিত ও দক্ষ নারী এ দেশে যথেষ্ট আছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ শিক্ষক হবেন নারী, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে এ রকম সিদ্ধান্ত না থাকলে নারী কোটারও প্রয়োজন নেই। তাঁরা প্রতিযোগিতা করেই চাকরি পেতে সক্ষম। আদিবাসী কোটায় অবশ্য ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন আছে। দেশে আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চাকমা ও মারমারা এগিয়ে। সুতরাং আদিবাসী কোটায় এরা ছাড়াও অন্য জাতিগোষ্ঠী যাতে সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। আর যেটি এ সময় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, সেই প্রতিবন্ধী কোটা এখনো নেই। প্রতিবন্ধীদের বিশেষ সুযোগ দেওয়া রাষ্ট্রের কর্তব্য। তবে যা-ই করা হোক না কেন, গুটি কয়েক মানুষ যেন টেবিলওয়ার্ক করে বা একটি-দুটি সভা করে সিদ্ধান্ত না নেন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে যথাযথ গবেষণা বা চাহিদা-নিরূপণ খুবই প্রয়োজন। কোটাপদ্ধতির সংস্কার হোক প্রয়োজন অনুসারে, ধারণাগত বা আবেগিক অবস্থান থেকে নয়। পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময় অন্তর (যেমন পাঁচ বছর) কোটা সংস্কারের ব্যবস্থাও থাকা দরকার। মনে রাখা দরকার, পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীকে বাড়তি উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষা-প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব, কিন্তু প্রতিযোগিতার ময়দানে সবাইকে যোগ্যতা প্রমাণ করেই চাকরি পেতে হবে।
সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের আকৃষ্ট না হওয়ার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষার সার্বিক পদ্ধতি। কয়েক শ বা হাজার খানেক পদের জন্য লাখ লাখ মানুষ পরীক্ষা দেন। সেখানে মেধা যাচাই করে ওই পদগুলোর জন্য যোগ্য ব্যক্তিকে বেছে নেওয়ার বদলে পরীক্ষাপদ্ধতিটি এমন করা হয়েছে, যেখানে নির্ধারিত সংখ্যার বেশি পরীক্ষার্থীকে বাদ দেওয়াটা মুখ্য। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ডিগ্রি নেওয়ার পর একজনের হয়তো চাকরি হচ্ছে কাস্টমসে, তেমনি পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করে আরেকজন হয়তো যোগ দিচ্ছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। রাষ্ট্র যাঁকে যে বিষয়ে দক্ষ করে তুলছে, সেই বিষয়ে তাঁর চাকরির নিশ্চয়তা নেই এবং তা ঘটছে পদ্ধতিগত কারণেই। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যে প্রশ্ন আসে, তার সঙ্গে শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ও বিজ্ঞাপিত পদের যোগসূত্র স্থাপন করা বোধ হয় অসম্ভব। লিখিত পরীক্ষা হয় দীর্ঘমেয়াদি। সেখানে শিক্ষার্থীর জ্ঞান কিংবা উচ্চতর বিশ্লেষণক্ষমতা দেখা হয়, নাকি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে শিক্ষার্থীর দক্ষতা যাচাই করা হয়, তা দুর্বোধ্য। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় কত নম্বর পাচ্ছেন, প্রিলিমিনারিতে কাট অব নম্বর কত কিংবা কোন যোগ্যতায় একজনের চাকরি হচ্ছে ও আরেকজন বাদ পড়ছেন, সেগুলো জানা যায় না। পুরো পরীক্ষাপদ্ধতিতেই যথার্থতা, নির্ভরযোগ্যতা ও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারির কথা তো সবার জানা! অন্যদিকে পরীক্ষা নেওয়ার সময় ও ফল প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে এই পরীক্ষার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। যাঁরা প্রাথমিকভাবে মনোনীত হন, নানা জটিলতা ও আনুষ্ঠানিকতায় তাঁদের সেই চাকরি পেতে বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। প্রতিবছর আবার বিসিএস পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয় না পিএসসির পক্ষে। সব মিলিয়ে পুরো ব্যবস্থাটি প্রকৃত অর্থে অকার্যকর কি না, সেই প্রশ্নও তোলা যায়। কার্যকর ও দ্রুত যাচাইয়ের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের প্রবেশ নিশ্চিত করার প্রক্রিয়া বের করা পিএসসির জন্য কঠিন কাজ হওয়ার কথা নয়।
দেশে বেসরকারি খাতের প্রসার ঘটেছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ও দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো মেধাবীদের লুফে নিচ্ছে আকর্ষণীয় বেতনে। বেসরকারি চাকরিতে স্থায়িত্বের দিক দিয়ে কিছু অনিশ্চয়তা থাকলেও তারা তা পুষিয়ে দেয় উচ্চ বেতন দিয়ে। ফলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী সরকারি চাকরির চেয়ে এখন বেসরকারি চাকরিকে প্রাধান্য দেন। বিসিএস পরীক্ষার আপাদমস্তক সংস্কার করা না হলে যতই কোটা কমানো হোক না কেন, সৃজনশীল, মননশীল বা যোগ্য ব্যক্তিরা সরকারি চাকরিতে আগ্রহী হবেন না।
সুতরাং ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিসিএস পরীক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন বা এ রকম উদ্যোগ নেওয়া দ্রুত প্রয়োজন। মেয়াদের শেষ সময়ে এসে সরকার হয়তো এ বিষয়ে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না; কিন্তু একটি কমিশন গঠন করে পর্যাপ্ত সময় ও ক্ষমতা দিলে কমিশন গবেষণার ভিত্তিতে এই পরীক্ষার আমূল সংস্কারে বাস্তব ও যুগোপযোগী সুপারিশ করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি। ভালো ও কার্যকর একটি পদ্ধতির জন্য না হয় আরও দু-একটি বছর অপেক্ষা করল আমাদের শিক্ষার্থীরা।
গৌতম রায়: প্রভাষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী।
[email protected]