শুভ জন্মদিন!

ঢাকা শহরে বসে আমরা অনেক কিছুই দেখতে পাই না, বুঝতে পারি না, অনুভব করি না। ইট-কাঠ-পাথরের জগৎটা এই বস্তুগুলোর মতোই জড় ও কঠিন। আপনি যে ব্যস্ত জীবনযাপনের মাঝে প্রকৃতির কাছে গিয়ে একটু হাঁফ ছাড়বেন, তার উপায় নেই বললেই চলে।
আর সবাই যে সব সময় গ্রামে গিয়ে শ্বাস নেবেন, সে সুযোগও হয় না। জীবনযাপনের চাপ, সামাজিক সমস্যা আর রাজনৈতিক অরাজকতা সব মিলিয়ে সাধারণের মন বিষিয়ে উঠলেও উপশমের নেই কোনো উপায়। আমার মতো যাঁরা অভিনয় বা সংশ্লিষ্ট পেশায় নিয়োজিত, তাঁদের এই সুযোগটা হয়। ফুসফুসটাতে সতেজ নির্মল বাতাস ঢোকানোর সুযোগ পাই আমরা প্রায়ই। সেই হিসেবে আমরা ভাগ্যবান।
আমি আমার দৈনন্দিন রুটিনে প্রকৃতি দর্শনের পথ একটা করে নিয়েছিলাম, সেটারও যবনিকা পতন ঘটেছে। তা জানিয়েছি গত লেখায়। সেই মনের কষ্ট দূর করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমার ঝুলবারান্দায় দাঁড়ালে ফাঁকা জায়গাটা দেখলেই কদমগাছটার জন্য বুকটা হাহাকার করে ওঠে। হয়তো ভাবছেন বাড়াবাড়ি। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলছি, এ বাড়াবাড়ি নয়। প্রাণের সখা ছিল গাছটি আমার। সকালবেলার সখা। ঘুম ভাঙতেই এসে দাঁড়াতাম ওর সম্মুখে। আদান-প্রদান হতো মনের ভাব। তারপর বসতাম অন্য সখার সঙ্গে ভাব বিনিময়ে।
এই দ্বিতীয় সখাটির কথাই বলতে চাই আজ। প্রথম সখার মৃত্যুসংবাদটি ভাগাভাগি করেছিলাম এই দ্বিতীয় সখার সঙ্গে, তার জন্যই তো আপনারা জেনেছিলেন আমার সেই কান্নাভেজা কণ্ঠস্বরে সখা হারানোর ঘটনাটি।
এই দ্বিতীয় সখাটির শুভনাম প্রথম আলো।
আমার মনে হয় এর নাম হওয়া উচিত ছিল শুধু ‘আলো’। কারণ, এ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু আলোই ছড়ায়। তাই শুধু ‘প্রথম’ বিশেষণে আটকে থাকার কোনো কারণ নেই। আলো, আমার আলো, কেবলই আলো।
অন্ধকারকে আলোকিত করার যে ব্রত গ্রহণ করেছিল এই পত্রিকাটি, তা ১৫ বছরে সার্থকতায় পরিণত হয়েছে বলতে অসুবিধা নেই। কিন্তু চলার পথে ভর্ৎসনাও যে খুব কম পেয়েছে, তা তো নয়। সেটাও খুবই স্বাভাবিক। সবাই যে আপনার মতাদর্শকে মেনে নেবে, এটা আশা করা যায় না। তাই তো প্রথম আলোর পাতায় সবার অবাধ বিচরণ। আপনি যে মতেরই হোন না কেন, মত প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছেন এর পাতায়। আলো নিক্ষেপ করেন নিজের মতাদর্শের ওপর। গ্রহণযোগ্য হলে জনগণও আলোকিত হবেন সেই আলোয়। ভিন্নমত হলে সেটাকেও অন্ধকার কুঠুরিতে না আটকে আলোর মুখ দেখান এই পত্রিকার পাতায়।
এই নীতিটা আমার পছন্দ। গণতন্ত্রের মূল মন্ত্রই তো এটা।
আমার এই সখাটি মতভিন্নতাকে যেমন শ্রদ্ধার চোখে দেখে, তেমনিভাবে সংবাদ পরিবেশনায় বিষয়বৈচিত্র্য আনয়নে পথিকৃতের ভূমিকাও পালন করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখানেই এর চমৎকারিত্ব। চমৎকারিত্ব নির্মাণের এই নাটের গুরু হলেন মতিউর রহমান, প্রথম আলোর সম্পাদক। তাঁকে আমি চিনি সেই উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের সময় থেকে। তখন বাঙালির সংস্কৃতি বিনষ্ট করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত পাকিস্তানি মিলিটারি সরকার। রবীন্দ্রনাথ অপাঙেক্তয় সরকারের কাছে। সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদ ভীষণ সাহসী এক পদক্ষেপ নিয়েছিল—রবিঠাকুরের রক্তকরবী নাটকটি মঞ্চায়নের পরিকল্পনা করে তারা। তখন সংস্কৃতি সংসদের অকুতোভয়, নিরলস কর্মীদের মধ্যে ছিলেন মতিউর রহমান, আসাদুজ্জামান নূর, মফিদুল হক, মালেকা বেগম প্রমুখ। তাঁদের তাগিদে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও আমি যুক্ত হলাম রক্তকরবীর সঙ্গে। সরকারের লাল খাতায় হয়তো উঠেছিল নাম। তারপর ’৭০ সালে বাংলা একাডেমির মাঠে ১০ হাজার দর্শকের সম্মুখে মঞ্চস্থ হয়েছিল এই নাটকটি।
তখন থেকেই সংস্কৃতি সংসদের ওই কর্মীকুলের সঙ্গে যোগাযোগ আমার। কখনো কোনো কারণে ছেদ ঘটেনি যোগাযোগ।
সেই সূত্রে মতিউর রহমানের ফোন এল প্রথম আলোর সম্পাদক হিসেবে—২০০০ সালের ফেব্রুয়ারির কোনো এক সন্ধ্যায়।
‘হায়াত ভাই, আমাদের জন্য একটা কলাম লিখবেন।’
‘আমি? পত্রিকার কলাম? মাথা খারাপ?’
‘আমি জানি, আপনি পারবেন। যা খুশি তাই লিখবেন। এক কলাম, পাক্ষিক লিখবেন।’
এরপর কোনো আপত্তি যে চলেনি, বুঝতেই পারছেন। প্রথম লেখাটির নাম ছিল ‘সাহসী হেলেনা’। তখন থেকে আমিও সাহসী।
নানা রকম ছাইপাঁশ লিখেই চলেছি। সাহস জুগিয়েছেন মতিউর রহমান আর তাঁর প্রথম আলো। সবই ছাপিয়েছে বিনা আপত্তিতে। মতিউর রহমান সত্যিই সাহসী। তিনি সবাইকে সাহসী হতে সাহস দেন। অন্ধকারকে আলো দেখাতে উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর পত্রিকার কর্মীকুলকে। তাই তাঁরা চলেছেন আলোর মশাল হাতে। আলো দেখলে কার না সাহস হয় এগিয়ে যেতে।
দেশ ও দশ এগিয়ে চলুক এই মশালের আলোয়। প্রথম আলো আলোক-বর্তিকা হয়ে অনন্ত যুগ ধরে প্রজ্বলিত থাকুক।
জয়তু প্রথম আলো, শুভ জন্মদিন, হে সখা।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।