শেরপুরের ডিসি সাহেব কোথায় ছিলেন?

সমাজে ঘটে চলা সবকিছুই হতাশাজনক নয়। প্রচণ্ড আশাবাদী হওয়ার মতো অনেক কিছুই ঘটছে। বহুদিন পরে একটা নতুন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেলাম। শেরপুরভিত্তিক একটি ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনে বুধবার অংশ নিয়েছিলাম। এটি ছিল ওই জেলার প্রথম পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলন। চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এর উদ্যোক্তা। তাঁকে সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন পুলিশ সুপার। আমরা ধরে নেব শেরপুরের জেলা প্রশাসনেরও তাতে সায় ছিল।
 

বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সাল থেকেই এ ধরনের সম্মেলনের শুরু। তবে দেশের বেশির ভাগ জেলায় এটা হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক।
 
২৩ সেপ্টেম্বর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। একটি শূন্যতা বেশ অনুভব করলাম। দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ কুশলীব হতে চলা নির্বাহী বিভাগের ‘বিচারকদের’ অনুপস্থিতি। জেলা প্রশাসনের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। এটা সুপ্রিম কোর্ট তথা সরকারি অভিপ্রায়ের ব্যত্যয়। জানলাম, শেরপুরের ডিসিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, কিন্তু  তিনি নিজে থাকেননি বা তাঁদের কারও প্রতিনিধি পাঠানো হয়নি। ধরে নেব, এখানে তাঁকে ডিসি হিসেবে নয়, ‘ডিএম’ বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্টেট হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশের কারাবন্দীদের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা ক্রমেই বড় ভূমিকা রাখছেন। আমরা চাই বা না চাই, সংবিধানসম্মত হোক বা না হোক, তাঁরা প্রজাতন্ত্রের জুডিশিয়াল পাওয়ার প্রয়োগ করছেন, এটাই বাস্তবতা।
   
২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলনে কারা কারা উপস্থিত হবেন, কী কী বিষয়ে আলোচনা হবে, তার সবিস্তার বিবরণ দিয়ে একটি পরিপত্র জারি করেন। প্রতি মাসের প্রথম শনিবার দেশের প্রতিটি জেলায় এই সম্মেলন হওয়ার কথা। এতে ডিসি নিজে বা তাঁর কোনো প্রতিনিধির অংশগ্রহণের কথা বলা আছে। কিন্তু কোনো ডিসি তাঁর জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে এ ধরনের  সম্মেলন সফল করতে আগ্রহী, সেটা আমাদের জানা নেই। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই থাকতে পারে।

২৩ সেপ্টেম্বরের সম্মেলনে কেউ কেউ কিছুটা প্রাণ খুলে সমস্যা আলোচনা করলেন। কেউবা আড়ষ্ট থাকলেন। ঘাটতি সংস্কৃতির। এটা এক দিনে দূর হবে না। দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কেটে যাবে। অংশীজনেরা যদি গঠনমূলকভাবে মতামত দেন এবং সে অনুযায়ী প্রতিকার মেলে, তাহলে এ ধরনের সম্মেলন দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখতে পারে। এই সম্মেলনে প্রাণ খুলে অনিয়ম, দুর্নীতি থেকে শুরু করে সব ধরনের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হোক, সেটাই রাষ্ট্রীয় নীতি। প্রধান বিচারপতি এটা চান। আইন ও বিচারমন্ত্রী এর বাস্তবায়ন দেখতে চান।  

সম্মেলনে সিজেএমের বক্তৃতায় কিছু পুরোনো কথা বলা হলো। কিন্তু তা খুব নতুন বলে কানে বাজল। সিজেএম বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ হতে মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে সগৌরবে দাঁড়াতে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে, সেখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, অ্যাডভোকেট যেই হোক না কেন, কারও বেআইনি ও গর্হিত কর্মকাণ্ডকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া হবে না।’

এখানে স্মরণ রাখা দরকার, ২০১৭ সালের সুপ্রিম কোর্টের সম্মেলন সংক্রান্ত উল্লিখিত নির্দেশনায় আপিল বিভাগের সেই বিখ্যাত অবশ্যপালনীয় গাইডলাইনের (গ্রেপ্তারের পরমুহূর্তেই ফোনে তাঁর আত্মীয়কে অবহিত করা ইত্যাদি) উল্লেখ আছে। তবে সেখানে সংশ্লিষ্ট মামলাটি নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা উচিত ছিল। প্রতিটি পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলনে যদি ওই গাইডলাইনের বাস্তবায়ন ও বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে তার একটা খুব ভালো প্রভাব পড়বে। অনেক পুলিশ সদস্য জানেন না যে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট তাঁর গাইডলাইনে কী বলেছেন। এমনকি সংবিধান কী বলেছে, তা-ও অনেকের জানা নেই।

সিজেএম যা বলেন, সেটা বেশ আগ্রহভরে পুলিশ সুপার, ডিবি, এসবি সদস্যরা শুনলেন। তাঁরা যে শুনলেন, বাধা দিলেন না, বরং প্রকারান্তরে সংহতি প্রকাশ করলেন, সেটা একটা অগ্রগতি বটে। তাঁদের উপস্থিতিতে একজন বিচারকের নিম্নোক্ত উচ্চারণ কানে বেশ লাগল:
‌‘সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে যেকোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে কোনো অপরাধের দায়ে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না এবং যন্ত্রণাদায়ক বা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর ব্যবহার করা যাবে না। সংবিধানের এই পবিত্র বিধানের প্রতি আমার সব ম্যাজিস্ট্রেট ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের আমি সদা শ্রদ্ধাশীল থাকতে নির্দেশ প্রদান করছি।’

আমরা জানি, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী, ১৬৪ ধারায় আসামির থেকে জোরপূর্বক জবানবন্দি আদায়ের চেষ্টা প্রচলিত। বছরের পর বছর ধরে এটা একটা বিরাট সমস্যা হয়ে আছে। এটা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। অবস্থার এতটাই অবনতি ঘটেছে যে পুলিশ এবং জবরদস্তির মাধ্যমে আদায় করা জবানবন্দি প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছে।

জজ মিয়া কাহিনির পরে কাহিনির মিছিল চলছে। আমরা ভাবছি, এ বুঝি আর বদলানোর নয়। বুধবার মনে হলো: না, আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি। এটা শুনতে ভালো লাগলে যে একটি জেলার পুলিশ বিভাগের সব স্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সিজেএম বলছেন, ‘উক্তরূপ স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা বন্ধে প্রতিটি থানার ওসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে সদা সচেষ্ট থাকবেন।’

১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশনের ২৮৩ আসলে বলে দিয়েছে, কী উপায়ে জবানবন্দি নথিভুক্ত করতে হবে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার (আই.ও.) দায়িত্ব জবানবন্দির যথার্থতা যাচাই করা। এটা পেলেই কেবল তিনি আসামিকে ‌‘যথাসম্ভব অপরাহ্ণের পূর্বে’ আদালতে আনবেন। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট যাতে আসামিকে তাঁর ভাব প্রকাশের (রিফ্লেকশন) পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে পারেন—এরপরই কেবল ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দি রেকর্ড করবেন।

সুতরাং শ্রেষ্ঠ করণীয় হলো, এ ধরনের সম্মেলন নিয়মিত হতে দেওয়া। হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরাও এ ধরনের ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনে অংশ নিতে পারেন। এটা তাঁদের জন্য ঐচ্ছিক করণীয় নয়। এটা পালন করাই তাঁদের সাংবিধানিক কর্তব্য।
যাঁরা দুই বছর পরে হাইকোর্টে স্থায়ী বিচারপতি হবেন, যাঁরা হাইকোর্ট থেকে আপিল বিভাগে যাবেন, তাঁদের বাছাইকালে এ ধরনের সম্মেলনে তাঁদের ভূমিকা ও অবদান কী ছিল, সেটা একটা সূচক হতে পারে। রায় লেখা তো অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব। এসব কাজ তাঁরা না করলে করবে কে।

ভাবুন তো, দেশের ৬৪ জেলায় প্রতি মাসে পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেসি সম্মেলন হচ্ছে। সেখানে ডিসি থাকছেন, এসপি থাকছেন। জুডিশিয়াল ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটরা থাকছেন। ডিবি, এসবিসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা থাকছেন। সেখানে প্রতি জেলার অনিয়ম বা অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো পদস্থ কর্মকর্তাও থাকতে পারেন। এখন অনলাইনে হচ্ছে। যখন অফলাইনে হবে, তখনো অনেকের পক্ষে শারীরিকভাবে উপস্থিত হওয়া কঠিন থাকবে। যেমন হাইকোর্টের বিচারপতি বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো উপসচিব কি যুগ্ম সচিব সর্বদা ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিতে পারেন।

কেউ বললেন, কী করে নির্যাতনের খবর ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশ হস্তক্ষেপ করল। কেউ বললেন, নারী নির্যাতন মামলায় নারাজি দেওয়ার পরে কী জটিলতা হয়। পিপি বলেন, শিশুরা কীভাবে মাদক ও মার্ডারের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের বয়স চিহ্নিত করতে কী জটিলতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এই রকম বহু বিষয় রয়েছে, একটি জেলার প্রাত্যহিক জীবনে, এসবের খুব ভালো প্রতিকার এ ধরনের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে।

সিজেএম তাঁর বক্তৃতায় খুব অকপট ছিলেন। তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজি, নানা অজুহাতে মানুষ হত্যা/নাগরিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মাদকের মামলা দায়ের, গ্রেপ্তারের পর আসামিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির না করা/ পুলিশ রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আসামিকে নির্যাতন করা/ অবৈধ সুবিধা/ অর্থ আদায় ইত্যাদি বিষয়েও প্রতিটি থানার অফিসার-ইন-চার্জসহ সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবেন। যাতে এরূপ একটি ঘটনাও ঘটতে না পারে।’

একজন সিজেএম যখন এটা বলতে পারছেন এবং এতে এসপি এবং ওসিরাসহ কাউকেই এতটুকু বিরক্ত বা অস্বস্তির মধ্যে পড়তে দেখলাম না; তখন ভরসা পাই, আশাবাদী হই। যাঁরা অনিয়ম করছেন, তাঁরা দূষিত পরিবেশের শিকার।
কোনো সন্দেহ নেই, নিরাপত্তা হেফাজতই এখন অনেকের কাছে সব থেকে বেশি নিরাপত্তাহীনতা, বিভীষিকা। তাই সিজেএম যখন প্রসঙ্গটি তুললেন, তখন ভরসা পেলাম। তিনি বলেন, সিআরপিসির ১৬৭(১) ধারায় পুলিশ রিমান্ডের দরখাস্ত ১৯৪৩ সালের পুলিশ রেগুলেশনস অনুসারে সংশ্লিষ্ট সার্কেল/ ইউনিটের দায়িত্বরত পুলিশ সুপার/ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার/ সহকারী পুলিশ সুপারের মাধ্যমে আদালতে দাখিল করবেন। উল্লিখিত যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুপারিশ ও স্মারক ব্যতীত কোর্ট ইন্সপেক্টর কোনো পুলিশ রিমান্ডের দরখাস্ত গ্রহণ করবেন না/ নথিতে সংযুক্ত করবেন না।
বাহ। শুধু এই একটি বিধান যদি প্রতিপালন করা হয়, তাহলে রিমান্ড পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবেই।

জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম ফারিন ফারজানা উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন যে মাদক মামলায় যোগসাজশকারী আসামিকে মামলার শুরুতে আইওরা সম্পৃক্ত করেন। কিন্তু পরে প্রায় সব মামলাতেই এ ধরনের আসামিদের বাদ দিয়ে তাঁরা চার্জশিট দাখিল করেন। এ বিষয়ে শেরপুরের পুলিশ সুপার সম্মেলনেই ওয়াদা দেন, এই সমস্যা ভবিষ্যতে আর থাকবে না।

আরও লক্ষ করি, এই ভার্চ্যুয়াল সম্মেলনে মিডিয়াও আমন্ত্রিত ছিল। তাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। আবারও বলি, এ ধরনের সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ম্যাজিস্ট্রেসি সেলের কর্মকর্তাদের উপস্থিতি অপরিহার্য। এই ধারণা সরকারের ই-গভর্ন্যান্সের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।
আমরা তো এমন বাংলাদেশেরই ছবি আঁকি।

মিজানুর রহমান খান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক
[email protected]