শেষ হলো ব্রেক্সিট আখ্যান

নতুন বছর ২০২১ সাল থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ পাকাপাকিভাবে কার্যকর হবে।

এই বছরটির শেষ দিনে ব্রেক্সিট বিচ্ছেদের লম্বা আখ্যান শেষ হবে। ১৯৭৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য সরকার ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিল। আর ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রায় ৪৭ বছর পর বরিস জনসনের নেতৃত্বে যুক্তরাজ্য ইইউ জোট ত্যাগ করেছে। কয়েক শতাব্দী ধরেই যুক্তরাজ্য বিশ্বের অনেক জায়গায় দাপটের সঙ্গে শাসন, শোষণ ও  নিজেদের প্রতিপত্তি বজায় রেখেছিল। এখন সেই দেশটিই নিজ মহাদেশে আত্ম-বিচ্ছিন্নতার দিকে ঝুঁকছে, নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে।
নতুন বছর ২০২১ সাল থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদ পাকাপাকিভাবে কার্যকর হবে। ইইউ জোটে প্রায় ৫০ বছর থাকার পর এই প্রস্থান নিয়ে নানা রকম বিতর্ক রয়েছে। ব্রেক্সিট নিয়ে চার বছর ধরে বাদ-প্রতিবাদ-সমঝোতা সবকিছুই এখন নিকট অতীতের ঘটনা। ব্রেক্সিট নিয়ে গণভোট, ব্রিটিশ পর্লামেন্টে তুমুল বিতর্কের পর এই বছর ৩১ জানুয়ারি ব্রিটেন আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সাল থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়েছে ২৭ ইউরোপীয় দেশভুক্ত জোট।

বেশ আগে থেকেই ব্রিটিশ সরকারগুলো ইইউ জোটের নানা যৌক্তিক উদ্যোগগুলোকে সন্দেহর চোখে দেখত। যেমন ২০০২ সালে ১৯ দেশে প্রচালিত ইউরো মুদ্রা ব্যবস্থা, ১৯৯৫ সাল থেকে ২৬ দেশে প্রবর্তিত সেনঝেন ভিসা প্রথাতে ব্রিটেন যোগ দেয়নি। যুক্তরাজ্যে বেক্সিট আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল সেই ২০১৬ সাল থেকেই। তখন থেকেই যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে নানা বিষয়ে দর-কষাকষি শুরু করলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যকে ছাড় দিয়েছিল। তবে বেশ কিছুদিন আগে থেকেই যুক্তরাজ্যের নানা খাতে সেবার হার ও পুঁজি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছিল। যুক্তরাজ্যে রক্ষণশীল ও লেবার দলের সরকারগুলো তাদের অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে নানা রকম সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার করেছে, তবে সংকট থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি। আর এই সংস্কারের শেষ যুক্তি বা অস্ত্র ছিল যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে নিষ্কৃতি হওয়া। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসার বিষয়ে বড় রকমের ইন্ধন দিয়েছিল ব্রিটেনের কট্টর জাতীয়তাবাদী দলগুলো।
ইইউ জোট গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ১৯৫০ সালের ৯ মে, জোট গঠনের ৭০ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম একটি দেশ জোট ত্যাগ করে চলে গেল। এই বছরের প্রথমে জোট ত্যাগ করলেও ইইউ জোটের প্রথা অনুযায়ী এ বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সময়সীমা বাঁধা রয়েছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দৃশ্যত বিভিন্ন পর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা হলেও শেষ পর্যন্ত বরফ গলেনি। ইইউ জোটের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটি টিকিয়ে রাখতে শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে এই ডিসেম্বরের ৯ তারিখ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইইউ সদর দপ্তর ব্রাসেলস সফর করেন। ব্রাসেলসে প্রধানমন্ত্রী জনসন, ইইউ কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইনের সঙ্গে বৈঠক করলেও পুনরায় সেই আগের মতপার্থক্যগুলো আবার সামনে চলে আসে।

পরাজিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন ইইউ জোটের কট্টর সমালোচক এবং প্রায়ই তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভঙ্গুরপ্রায় জোট বলে আখ্যায়িত করতেন। ফরাসি অর্থমন্ত্রী বুর্নো লা ম্যারি যুক্তরাজ্যের ইইউ ছেড়ে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, বিষয়টি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি ঐতিহাসিক বোকামি।

প্রধানমন্ত্রী জনসন সম্প্রতি ব্রাসেলস সফরের আগে হাউস অব কমন্সে বলেছিলেন, ইইউ জোটের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি টিকিয়ে রাখতে ইইউ জোটের শর্তগুলো মেনে নেওয়া যুক্তরাজ্যের কোনো প্রধানমন্ত্রীর পক্ষেই সম্ভব নয়। এটি তাঁর দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন বলে তিনি জানিয়েছিলেন। অন্যদিকে বর্তমান মেয়াদে ইইউর সভাপতি জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল জোর দিয়ে বলেছেন, ইইউ তার মূল নীতিগুলোর সঙ্গে কোনো আপস করবে না। ব্রিটিশ পক্ষ যদি ইইউ জোটের শর্তগুলো না মানতে পারে, তবে চুক্তি ছাড়াই একটি পথ নেওয়া হবে। তা ছাড়া জোটভুক্ত ২৭ দেশের ৪৫ কোটি মানুষের বাজার পেতে যুক্তরাজ্যকে ইইউ জোটের মানদণ্ড মানতে হবে বলে তিনি জানান। চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের জন্য ইইউ দেশগুলো প্রস্তুত রয়েছে, তবে তা ভালো দৃষ্টান্ত নয় বলে মন্তব্য করেছেন আঙ্গেলা ম্যার্কেল।
দীর্ঘ সময় পর আসন্ন নতুন বছরে যুক্তরাজ্যকে ইইউ জোটের দেশগুলো থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক দিতে হবে, একই ব্যবস্থা কার্যকরী হবে জোটভুক্ত ২৭ দেশের যুক্তরাজ্য থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে। জার্মানির যাইট পত্রিকাটি জানাচ্ছে, বিভিন্ন ব্রিটিশ পত্রিকা বিশেষ পাতায়, কোন কোন খাদ্যপণ্যতে কত শুল্ক ধার্য হবে, তার সূচি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, টমেটোতে ১৪ শতাংশ, শসাতে ১৬ শতাংশ, গরুর মাংসে ৪৮ শতাংশ, পনিরে ৫৭ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিতে হবে। অর্থাৎ ইইউ অঞ্চল থেকে আমদানি করা খাদ্যদ্রব্যের মূল্য হটাৎ করেই বেশ বেড়ে যাবে। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য এযাবৎ মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ খাদ্যপণ্য ইইউ দেশগুলো থেকে আমদানি করে আসছিল।

ফ্রাঙ্কফুর্ট রন্ডসু পত্রিকাটি, দ্য ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত খবর উল্লেখ করে লিখেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্টের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অংশীদারত্বের জুজু দেখিয়ে ইইউ জোটকে চাপে ফেলার কৌশলও এখন আর খাটবে না, কারণ ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন জো বাইডেন। এতে ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের আলোচনার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, পরাজিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন ইইউ জোটের কট্টর সমালোচক এবং প্রায়ই তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ভঙ্গুরপ্রায় জোট বলে আখ্যায়িত করতেন। ফরাসি অর্থমন্ত্রী বুর্নো লা ম্যারি যুক্তরাজ্যের ইইউ ছেড়ে চলে যাওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, বিষয়টি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে একটি ঐতিহাসিক বোকামি।
ব্রেক্সিট বিচ্ছেদ নিয়ে জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার ২০১৭ সালে একটি সময়োপযোগী কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইউরোপের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষের কাছে এক দেশ এক মহাদেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তখন এই বেরিয়ে যাওয়া বিয়োগান্ত ঘটনা এবং ব্রেক্সিটের ঘটনা ইউরোপের ডানপন্থী রক্ষণশীলদের হাতকেই কেবল শক্তিশালী করবে।
বিশ্বব্যাপী জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির মিথ্যা খোয়াবে, বিশ্বের নানা দেশে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতির ভাঙচুর ঘটছে। নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতেই এই অপরাজনীতি। ব্রেক্সিট সেই জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিরই বলি।


সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি
[email protected]