সংখ্যার কারিকুরি নয়, বাজেটে চাই রুটিরুজির নিরাপত্তা

Sarfuddin Ahmed

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস লালসালুতে শিলাবৃষ্টিতে ধান ভিজতে দেখে মজিদ তার স্ত্রী রহিমাকে ধান তুলতে বলে। জবাবে রহিমা বলে, ‘ধান দিয়ে কী হইব, মানুষের জান যদি না থাকে?’ বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে যখন অর্থনীতির চাকা বারবার থেমে যাচ্ছে, মানুষ আশা হারাচ্ছে তখন সব আর্থিক পরিকল্পনার মূলে থাকছে জীবিকা সচল রেখে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার কর্মকৌশল। করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে প্রস্তাবিত বাজেটটি জান বাঁচানোর বাজেট নয় বরং একটি গতানুগতিক ‘বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাজেট’ বলেই মনে হয়েছে।

বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ হতাশাজনক। প্রস্তাবিত বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ৪ শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে ৮ দশমিক ৭ শতাংশ, কৃষি খাতে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ কিন্তু প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ বেড়েছে ১১ শতাংশ। তবে ৫ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনায় আনলে স্বাস্থ্য খাতে প্রকৃত অর্থে বরাদ্দ বাড়েনি। অর্থ বরাদ্দের প্রশ্নে এই বাজেটে স্বাস্থ্য খাত অবহেলিত। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও স্বাস্থ্যের মতো একটি মৌলিক সেবা খাতের অক্ষমতা আর অব্যবস্থাপনা মানুষের মনে চরম অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। এই খাত নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা যেমন অনেক বেশি তেমনি স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে তাদের ভোগান্তি, অপ্রাপ্তি এবং হতাশাও আকাশচুম্বী।

এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোগত এবং গুণগত পরিবর্তনের মতো কোনো বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ এই বাজেটে প্রত্যক্ষ হয়নি। ‘স্বাস্থ্য’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের জন্য আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ দরকার। তা না হলে রহিমার মতো কেউ বলতেই পারে, ‘বাজেট দিয়ে কী হবে, জানই যদি না বাঁচে।’

প্রতিটি বাজেটে তিনটি মূল সংখ্যা থাকে। তা হলো মোট ব্যয়, রাজস্ব আয় এবং ঘাটতি। এই তিনটি সংখ্যার পরিমাণ যৌক্তিক, সুচিন্তিত, বিশ্বাসযোগ্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য করে নির্ধারণ করা বাজেটের একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বাজেটে প্রস্তাবিত বিশাল ব্যয়ের অর্থের জোগানের প্রশ্নে-টাকা দেবে গৌরী সেন কিংবা ভূতে জোগাবে—এ রকম চিন্তা বাজেটের বিশ্বাসযোগ্যতাকে নড়বড়ে করে দেয়।

এই মূল সংখ্যাগুলো নিয়ে এবারের বাজেটেও সংশয় আছে। বিষয়টি আরও প্রাসঙ্গিক হবে গত অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের বাজেট বাস্তবায়নের প্রকৃত চিত্র পর্যালোচনা করলে। সেখানে দেখা যায় ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ৯ মাসে সংশোধিত বাজেটের মোট রাজস্ব আয়ের ৬৩ শতাংশ, মোট ব্যয়ের ৪২ শতাংশ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাত্র ২৮ শতাংশ, বৈদেশিক ঋণের ১২ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণের ১৭ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। সংশোধিত বাজেট বাস্তবায়ন করতে বাকি ৩ মাসে বাজেটের সিংহভাগ অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হবে, যা এই করোনাকালে অনেকটাই দুঃসাধ্য।

বাজেট বাস্তবায়নের এ রকম একটি হতাশাজনক এবং অদক্ষ কাঠামোর মধ্যে চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি কর রাজস্ব আদায়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে তার ভিত্তিটা কী? তাহলে কি ধরে নেওয়া হলো ২০২১-২২ অর্থবছরে মহামারি দূর হয়ে যাবে এবং অর্থনৈতিক মন্থরতা কেটে যাবে। কিংবা জিডিপির কি পর্যাপ্ত প্রবৃদ্ধি হবে, যার দরুন কর রাজস্বের ১০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটবে? দুঃখজনক হলো বাংলাদেশে ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৯ শতাংশ, যা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ নেপাল, মালদ্বীপ, ইন্ডিয়া, ভুটান কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে কম। এই অনুপাত নেপাল ও মালদ্বীপে ২০ শতাংশ, ইন্ডিয়াতে ১৮ শতাংশ, ভুটানে ১৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ১২ শতাংশ। কর আদায়ের এই নিম্ন হারের মূল কারণ হতে পারে কর প্রদানে মানুষের অনাগ্রহ, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ কিংবা দুর্নীতি।

বাজেটের দ্বিতীয় প্রধান সংখ্যাটি হলো মোট ব্যয়। বাজেটে ব্যয়ের দুটি প্রধান খাত: একটি অনুন্নয়ন বা পরিচালনা ব্যয় আর অন্যটি উন্নয়ন ব্যয়। প্রস্তাবিত বাজেটে সংশোধিত বাজেটের তুলনায় অনুন্নয়ন খাতে ব্যয় বৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ আর উন্নয়ন খাতে বৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ। সংকটকালে মানুষ খরচের ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে মিতব্যয়ী হয়। এ বাজেটে এমন কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের পরিচালনা ব্যয় এই করোনাকালে যেখানে কমানোর সুযোগ ছিল সেখানে প্রায় সব খাতে এই ব্যয়ের বরাদ্দ বেড়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়েছে। এই পরিমাণ যতটুকুই হোক, এটি একটি দৃষ্টান্ত, যা জনগণের প্রতি সরকারের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ এবং সব ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হওয়ার একটি নীতিগত সংকেত।

বাজেটের তৃতীয় প্রধান সংখ্যা হলো বাজেট ঘাটতি। প্রস্তাবিত বাজেটে সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ ঘাটতি বেড়েছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতিকে একটি ঋণের ফাঁদে ফেলতে পারে। একবার ঋণের বাতিক পেয়ে বসলে সেখান থেকে ফিরে আসা কষ্টের। এটি স্নোবলের মতো যতই গড়াবে ততই বাড়তে থাকবে। অতি ঋণে দীর্ঘ মেয়াদে সুদ ব্যয় বেড়ে যাবে, যা সরকারের বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রতিবন্ধক হতে পারে। ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ সংগ্রহের পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে, যা সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৩৮ দশমিক ৫ ভাগ বেশি। এই বৈশ্বিক সংকটকালে এটি উচ্চাভিলাষী।

অন্যদিকে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রতিবন্ধকতা হলো ব্যাংকগুলো নিজেরাই তারল্য ঝুঁকিতে ভুগছে। এই অবস্থায় সরকার ঋণ নিলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ তহবিলে টান পড়বে, বাজারে সুদের হার বেড়ে যেতে পারে, যা ব্যক্তি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত এবং মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে না। ফলে দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী একদিকে করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে উপার্জন হারানোর চাপ, অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার আরেক চাপের মধ্যে পড়ে জীবন-জীবিকা বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে পারে।

বাজেটের সংখ্যাগুলো যতই অনুমাননির্ভর হোক, সেগুলো যুক্তিনির্ভর অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া প্রয়োজন। তথাকথিত ‘বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাজেট’ নয় বরং বাস্তবতার নিরিখে প্রয়োজন, প্রত্যাশা এবং সামর্থ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে এটি করতে হবে। তবে বাজেট তৈরিই শেষ কথা নয়। এর সঠিক বাস্তবায়নও গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনো কম্পিউটার প্রোগ্রাম নয় যে তৈরি করে বাটনে ক্লিক করলেই আউটপুটগুলো যথাযথভাবে পাওয়া যাবে। বাজেট বাস্তবায়নে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, সুশাসন, সুদক্ষ জনবল এবং জনগণের সম্পৃক্ততা। এগুলোর সঠিক সম্মিলন না হলে প্রতিবছর বাজেটের অঙ্ক মিললেও মানুষের জীবন-জীবিকার অঙ্ক কখনো মিলবে না।

ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক
[email protected]