সংখ্যার রাজনীতি এবং উন্নয়নের গালগল্প

করোনা ও বন্যার কারণে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিঃসন্দেহে খুবই নাজুক। এ অবস্থায় বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর হাতে যখন তিন বেলা খাবারের পয়সা নেই, ঠিক সেই সময় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু গড় আয় দুই হাজার ডলার ছাড়িয়ে বর্তমানে ২০৬৪ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় এখন মানুষের মাথাপিছু আয় বছরে দাঁড়াচ্ছে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, যা মাসে প্রায় ১৪ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ জিডিপির এ প্রবৃদ্ধিকে অতিরঞ্জিত বলে অভিহিত করেছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিবছরই আমাদের সামনে কিছু সংখ্যা বা পরিসংখ্যান উপস্থাপন করেন। আধুনিক রাষ্ট্রে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পরিসংখ্যানের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু সমস্যা হলো, যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে এই সংখ্যা বা পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ বিরাজ করছে। বহু বছর আগে পশ্চিমা বিশ্বে প্রচলিত একটি প্রবাদ মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন তাঁর লেখায় জনপ্রিয় করেছেন। তিনি বলেন, ‘তিন রকমের মিথ্যা আছে: মিথ্যা, জঘন্য মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান।’ অর্থাৎ পরিসংখ্যান বা সংখ্যার গুরুত্ব অপরিসীম হলেও এ নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে সন্দেহ বিদ্যমান।

মার্কিন গবেষক জুয়েল বেস্ট সংখ্যার রাজনৈতিক ব্যবহার নিয়ে একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর একটি বইয়ের নাম হলো ‘ড্যামড লাইস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস: আন্ডারস্ট্যান্ডিং নাম্বার ফ্রম দ্য মিডিয়া, পলিটিশিয়ানস অ্যান্ড অ্যাকটিভিস্টস’। যাঁরা পত্রপত্রিকা পড়েন এবং যাঁরা সামাজিক সমস্যাগুলো বুঝতে পরিসংখ্যানভিত্তিক ডেটার ওপর নির্ভর করেন, এ গ্রন্থে তাঁদের সতর্ক করেছেন লেখক। তিনি এ গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেন যে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা যেমন নারী নির্যাতনের হার, গর্ভপাতের হার, গৃহহীন মানুষের সংখ্যা, বেকার সংখ্যা, আত্মহত্যার হারসহ নানা ঘটনা বিভিন্ন সংখ্যার আকারে যখন প্রকাশ করা হয়, তার মধ্যে একধরনের রাজনীতি যুক্ত থাকে, যা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। অর্থাৎ সংখ্যাকে যুগে যুগে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশের জনগণকে বোঝানোর জন্য নানা কায়দায় ব্যবহার করা হয়। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের নতুন উন্নয়নশীল অথবা তৃতীয় বিশ্বের দেশে এর অপপ্রয়োগ বহুমাত্রিক এবং অনেক বেশি শক্তিশালী।

এমনকি আমাদের সময় তথ্য-উপাত্ত প্রদানে সবচেয়ে প্রভাবশালী বিশ্বব্যাংকের দেওয়া সংখ্যা নিয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। যেমন বিশ্বব্যাংকের সাবেক এক কর্মকর্তা গোপীনাথ ১৯৯৯ সালে এক প্রবন্ধে লেখেন যে, ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা বড় সিদ্ধান্তগুলো নেন, তারপর কর্মীরা সেটার পক্ষে তথ্য জড়ো করেন।

সম্প্রতি দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালইয়ের অধ্যাপক সিপি চন্দ্রশেখর ভারতের অর্থনৈতিক তথ্য পর্যালোচনার সরকারি প্যানেল থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর পদত্যাগপত্রে তিনি জানান যে ‘এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে বর্তমানে রাজনৈতিক চাপের কাছে এখন যেকোনো স্বশাসিত সংস্থার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’ তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের পরিসংখ্যানব্যবস্থার ক্ষুণ্ন হওয়ায় এর বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ ভারতের বর্তমান সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সরকারি তথ্য–উপাত্ত ব্যবহার করছে।

ভারতের পরিসংখ্যানব্যবস্থা একসময় অত্যন্ত উঁচুমানের ছিল, যা বর্তমানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার কারণে কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের পরিসংখ্যানব্যবস্থায় আগে থেকেই গুণগত বিবেচনায় তুলনামূলকভাবে নিম্নমানের ছিল, যা রাজনৈতিক ব্যবহারের কবলে পড়ে দিন দিন আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে।

এক দশক আগে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তার রাজনীতি নিয়ে পিএইচডি গবেষণার সময় দেখেছি, বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কখনো কখনো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরাও বিবিএসের দেওয়া তথ্যকে হাস্যকর হিসেবে অভিহিত করেছেন। যেমন ২০১১ সালে আদমশুমারি তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর সমালোচনা করেছেন।

সম্প্রতি ঘোষিত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে সবচেয়ে কঠোর মন্তব্যটি এসেছে বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে। সংস্থাটি বলছে, ‘জিডিপি প্রবৃদ্ধি এখন রাজনৈতিক সংখ্যায় পরিণত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একধরনের মোহ সৃষ্টি হয়েছে। প্রবৃদ্ধির তথ্যকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে সংস্থাটির গবেষক ফাহমিদা খাতুন মনে করেন, ‘তথ্য-উপাত্ত সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান বিবিএসের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে।’ এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী।

সংগত কারণেই প্রশ্ন হতে পারে, সংখ্যাকে কেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে? সহজ উত্তর হলো, জনগণকে বোকা বানাতে। রাজনীতিবিদেরা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন, ক্ষমতায় আসার পর তাঁদের নানা কায়দায় প্রমাণ করতে হয় যে তাঁরা জনগণের জন্য কাজ করছেন। সেটা যখন সম্ভব হয় না, তখন নানাভাবে, নানা কায়দায় প্রমাণ করতে হয় যে সরকার আসলে জনকল্যাণে কাজ করছে। এ প্রসঙ্গে ভারতের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় এসেছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং ধর্মীয় বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে। কেবল ধর্মের বিভাজন বাদে নরেন্দ্র মোদি সরকারের পক্ষে যেহেতু কিছুই করা সম্ভব হয়নি, সেহেতু জনগণকে বিভ্রান্ত করতে জঘন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়, আর সেটি হচ্ছে সরকারি বিকৃত তথ্য-উপাত্ত বা সংখ্যা।

আসলে ক্ষমতায় থাকতে হলে উন্নয়নের গল্প তৈরি করতে হয়। আর সেই গল্প জনগণের কাছে সমাদৃত করতে বিভিন্ন দেশে সরকারগুলো বিভিন্ন কায়দায় নিজেকে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যে উন্নয়নের প্রচারণা চালিয়েছে। সে সময় উত্তরবঙ্গের গম্ভীরা গানের প্রচার করা হতো, ‘দেশপ্রিয় আইয়ুব খান, আইনাছে ভাই ইরি ধান’।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু উন্নয়নের গালগল্প এখনো টিকে আছে। সে গল্প উপস্থাপন করতে কখনো সমুদ্র বিজয়, কখনো মেট্রোরেলের স্তম্ভ, অথবা কখনো জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তুলে ধরা হয়। এসব দেখিয়ে বুদ্ধিমান টক শো–জীবীরা নিজেদের ভাগ্য গড়ে তোলেন। কেতাবে উন্নয়নের অনেক গালগল্প লেখা হয় কিন্তু এতে জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটে কি?

পরিশেষে বলা প্রয়োজন যে জিডিপির হারকে বাড়িয়ে দেখিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতার মারাত্মক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। একদিকে, এর ফলে সুনির্দিষ্ট সংখ্যার অভাবে সরকারের পক্ষে প্রকৃত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কখনো সম্ভব হবে না; অন্যদিকে, আয়বৈষম্য, দারিদ্র্য, পুষ্টি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো কখনোই গুরুত্ব পাবে না। এর ফলে রাষ্ট্রের ধনীরা আরও ধনী হবে এবং দরিদ্ররা আরও সুবিধাবঞ্চিত হবে।

মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

ই–মেইল: [email protected]