সফর আলীদের বিদেশ সফরনামা ও খিচুড়ি জটিলতা

প্রতীকী ছবি

প্রজেক্ট হবে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি হবে, আর সেখানে সফর আলীদের সফরের জায়গা হবে না, তা কি কখনো হয়? লবণ ছাড়া তরকারিতে কি স্বাদ হয়? আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে সচিব বিবিসির কাছে ঠিকই বলেছেন, ‘এগুলো সব প্রকল্পেই থাকে। ডিপিপিতে বিদেশে প্রশিক্ষণের একটি কম্পোনেন্ট রাখা হয়েছে মাত্র। প্রোপাগান্ডা বেশি হচ্ছে।’

সচিবের কথায় সায় দিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, ‘যারা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে, তাদের প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। তাই কিছু বরাদ্দ রেখে প্রস্তাব করা হয়েছে।’ জাতিসংঘের এক সংস্থার বরাত দিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, ‘ওরা আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল কেরালা-দিল্লিতে, ওদের পয়সায় দেখে এসেছি ক্যামনে কী হয়।’ (সূত্র: বিবিসি)

সত্যিই তো, জানার কি কোনো শেষ আছে? মন্ত্রীকে ধন্যবাদ, ভাগ্যিস তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্য চীনে যাওয়ার তাগিদ দেননি। তাহলে আবার সৃষ্টি হতো নতুন কূটনৈতিক সংকট। তবে তিনি এই সুযোগে অন্য পাখিদের ঘায়েল করার মওকা ছাড়েননি। ১৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে তাৎক্ষণিক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘হইচই করার মতো কিছু হয়নি। বিএনপি-জামায়াতের লোকজন সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে এখানে চলে এসেছেন।’ (১৬ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো) সাংবাদিকদের শান-শওকতের প্রতি নজর রাখার অনেক সংগঠন থাকলেও সম্মানের ওপর আঘাত দেখার কেউ নেই। তাই কোনো প্রতিবাদ হয়নি।

তবে দিনের শেষে বিদেশে ভ্রমণের কথিত পরিকল্পনা বাতিল না করে ‘যৌক্তিক’ করতে বলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের প্রধান স্বপন কুমার ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে জানান, প্রকল্পটি পুনর্গঠন করা হচ্ছে। শুধু এই প্রকল্প নয়, করোনার সময় সব প্রকল্পেরই বিদেশ সফর বাতিল করা হচ্ছে। সরকারের অর্থ সাশ্রয় এখন জরুরি।

স্থানীয় প্রশিক্ষণের জন্য প্রস্তাবিত ব্যয় বরাদ্দের ১৫ কোটি রাখা হবে কি না, তা জানতে চাইলে স্বপন কুমার ঘোষ বলেন, ‘এখন করোনার সময় সবকিছুই সংকুচিত হচ্ছে।’ সংকুচিত শব্দটি রহস্যময়। বিশেষ পরিস্থিতিতে যা সংকুচিত হয়, অনুকূল পরিবেশে তা ডেঙ্গু মশার ডিমের মতো ফুলেফেঁপে উঠতে পারে।

বিদেশে শিক্ষাসফরের আড়ালে কী ঘটে

ব্রিটিশ সমাজসেবী জুলিয়ান ফ্রান্সিস এ দেশে অনেক দিন ধরে কাজ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে এবং পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সামাজিক পুনর্গঠনে অনবদ্য ভূমিকা রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হয়েছেন এবং তিনি এখন এ দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক। একসময় তাঁকেও এই বিদেশে প্রশিক্ষণ কাম শিক্ষাসফর নিয়ে অনেক হুজ্জত সামলাতে হয়েছে। এক আলাপচারিতায় তিনি এই লেখককে জানালেন, কীভাবে শিক্ষাসফরের আবদার তাঁর চাকরিজীবনটাকে অস্থির করে তুলেছিল। একবার একদল মালয়েশিয়ায় গিয়ে দাবি করলেন, তাঁদের হাতখরচের টাকা অগ্রিম দিয়ে দিতে হবে। হাতখরচের টাকা হাতে পেয়ে সবাই ছুটলেন শপিংয়ে। শপিংটাই প্রধান হয়ে উঠল আর সব গৌণ।

শিক্ষাসফর থেকে ফিরে এসে একদল আমলা হোটেলের বিল জমা দিলেন। সেসব বিল দেখে জুলিয়ান ও তাঁর সহকারীদের মনে হয়েছিল কথাও কোনো গন্ডগোল আছে। কুয়ালালামপুরের যেসব হোটেলের নাম লেখা ছিল বিলে, তাদের কাছে তথ্য তালাশ করে জানা যায় বিলগুলো ছিল ভুয়া।

একবার যুগ্ম সচিব পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই দেশে ফিরে আসেন। পরে জানা যায়, তিনি অবসরকালীন ছুটিতে চলে যাবেন বলে তাড়াহুড়া করে দেশে ফিরে এসেছেন। ঘটনা আরও আছে, সেসব লিখলে কাগজ ভরে যাবে।

কেন খিচুড়ি কর্মসূচির বিদেশ সফর

এই আবদার নিয়ে লোক হাসাহাসি হলেও এই কর্মসূচির অভিজ্ঞতা বিনিময়ের দরকার আছে। সাংবাদিকদের সহবত শেখানোর সময় মন্ত্রী অসাবধানে একটা কথা বলে ফেলেছেন, ‘আমি কেরালায় দেখেছি, সরকারের সামান্য “কন্ট্রিবিউট” আছে, বাকিটা ওখানকার সোসাইটি (কমিউনিটি) করে। আমাদের এখানে তো পুরোটাই সরকার চালায়।’ (সূত্র: বিবিসি) কেরালার মিড ডে মিলের সার্থকতা সেখানে। সেটা যতটা না সরকারি, তার চেয়ে অনেক বেশি সামাজিক কর্মসূচি। শেখার প্রয়োজন সেটা। জানা প্রয়োজন কীভাবে স্থানীয় সরকার আর কমিউনিটির তত্ত্বাবধানে যুগ যুগ ধরে এমন একটা কর্মসূচি কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক কালচারে সেটা সম্ভব করতে হলে জানতে হবে কোথায় কোথায় খোলনলচে পাল্টানো দরকার।

শুধু কেরালা নয়, ষাটের দশকে এ দেশেও স্কুলে দুপুরে খিচুড়ি খাওয়ানোর কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। কেরালারটা টিকেছে, আমাদেরটা হারিয়ে গেছে। কেরালা রাজনীতিতে এগিয়েছে, এগিয়েছে মানসম্পন্ন শিক্ষায়। আমরা দুটোতেই হাঁপিয়ে উঠেছি।

এ দেশে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় ‘স্কুল ফিডিং কর্মসূচি’ ২০১০ সাল থেকে চলছে। ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি আগামী ডিসেম্বরে শেষ হবে। এটির আওতায় বর্তমানে দেশের ১০৪টি উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ৭৫ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট করে উচ্চ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সপ্তাহে তিন দিন ৪ লাখ ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে সবজি-খিচুড়ি ও ডিম-খিচুড়ি খাওয়ানোর ব্যবস্থা চালু ছিল কোভিডের আগপর্যন্ত। তারপরও খিচুড়ি রান্না শিখতে বিদেশি প্রশিক্ষণ চান এক হাজার সরকারি কর্মকর্তা!

এখন প্রয়োজন এই কর্মসূচির একটা ন্যায্য মূল্যায়ন। এই মূল্যায়নের লক্ষ্য হবে কীভাবে কমিউনিটিকে আরও কার্যকর শিক্ষাব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করা যায়। দেখতে হবে, কীভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমিয়ে আনা যায়। খাবারের বিল নেওয়ার জন্য দিস্তা দিস্তা কাগজ আর ভাউচার নিয়ে কেন ঢাকার মিরপুরের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এসে ধরনা দিয়ে বসে থাকতে হবে। কেন একই কাগজ বারবার জমা দিতে হবে। দেখতে হবে, শিশুদের মনের মতো রান্না করা যায় কীভাবে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে খিচুড়ি প্রতিদিনের পছন্দের খাবার নয়। সেখানকার বিকল্প খাবারের চিন্তা করতে হবে। এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিদেশে যেতে পারেন কয়েকজন অথবা আনতে পারেন বিদেশি বিশেষজ্ঞ।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক

[email protected]