সবাই পারে, আমরা কেন পারি না

মরক্কো। উত্তর আফ্রিকার দেশ। কিন্তু ইউরোপ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্ব। মরক্কোর দ্রষ্টব্য যেকোনো শহরে লন্ডন থেকে যেতে প্লেনে সময় লাগে চার ঘণ্টার মতো। প্যারিস থেকে আরেকটু কম। ইউরোপিয়ানদের অত্যন্ত পছন্দের ঘোরার জায়গা। বড় কারণ হলো আবহাওয়া। অক্টোবর-নভেম্বরে যখন ইউরোপ শীতে জবুথবু, তখন মরক্কোর প্রায় সব শহরের তাপমাত্রা ত্রিশের কাছাকাছি। মরুভূমি, পাহাড়, সমুদ্র—সবই আছে। থাকা–খাওয়াও সাধ্যের মধ্যে। সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা বেশ ভালো। আফ্রিকার অন্যতম বড় এটলাস পর্বতমালার দুর্গম গ্রামেও অনায়াসে চলে যাওয়া যায় গাড়িতে।

মরক্কোতে ফরাসি প্রভাব রয়েছে। ১৯১২ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ফরাসিদের অভিভাবকত্বে চলেছে, কলোনি বলতে পারেন। অনেক মানুষ এখনো ফরাসি ভাষায় কথা বলেন মাতৃভাষার মতো। বছর কয়েক আগে লন্ডন থেকে মারাক্কেশের বিমানের চেপে বসলাম। সপরিবারে। লন্ডন থেকে মারাক্কেশ দিনে একাধিক ফ্লাইট। লন্ডনের প্রায় সব বিমানবন্দর থেকে। টিকিট সাধ্যের মধ্যে। সাত থেকে দশ হাজার টাকার মতো। মারাক্কেশ হলো উত্তর আফ্রিকার অর্থনীতির অন্যতম এক প্রাণকেন্দ্র। এটলাস পর্বতের পাদদেশে প্রাণচঞ্চল ব্যস্ত শহর।

হোটেলে পৌঁছাতেই সন্ধ্যা। পেটে খিদে আমাদের। হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে বেরোব, বলতেই হোটেলের হাসিমুখের কর্মী বললেন বেরিয়ে পড়তে। রাতের মারাক্কেশ দেখতে। জেমা-আল-ফানা। শহরের অন্যতম ব্যস্ত জায়গা। সেখানে অসংখ্য রেস্তোরাঁ। সারা রাত খোলা। সেখানে খেতে কোনো অসুবিধা হবে না।

একটু ইতস্তত করছিলাম। পূর্ব আফ্রিকার অজানা শহরে রাতে রেস্তোরাঁয় খাওয়া নিরাপদ কি না? যা–ই হোক, ভ্রমণে স্থানীয় মানুষের পরামর্শকে আমি শেষ কথা বলে সব সময় মেনে থাকি। তথাস্তু বলে বেরিয়ে পড়লাম।

জেমা-আল-ফানাতে গিয়ে দেখি, দিন আর রাত একাকার। অসংখ্য দোকান। নানা রকম জিনিসে সাজানো। মসলা থেকে শুরু করে হাতে তৈরি গয়না, জামা-কাপড় আর চামড়ার তৈরি বিভিন্ন জিনিস। রাস্তার পাশে ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট। ভেতরে বসার জায়গা। বাইরেও কিছু চেয়ার দেওয়া আছে। মরক্কোর খাবারের ঐতিহ্য অনেক পুরোনো। রং আর গন্ধের এক দারুণ সমন্বয়। উত্তর আফ্রিকার একধরনের বিশেষ গম ভেঙে তৈরি হয় কুসকুস। সামান্য সেদ্ধ করলে ভাতের মতো। মরক্কোর লোকের অন্যতম প্রধান খাদ্য। সঙ্গে তাজিন-মাটির পাত্রে মাংস আর বিভিন্ন তরকারি একসঙ্গে, স্বল্প আঁচে, দীর্ঘ সময় নিয়ে রান্না করা হয়।

এক স্বপ্নময় ব্যাপার। অসংখ্য মানুষ। দেশ-বিদেশের। জটলা পাকিয়ে গান চলছে। ছোট ছোট রেস্তোরাঁ থেকে ভেসে আসছে দারুচিনির গন্ধ। অল্প আলোয় উড়ছে সাদা ধোঁয়া।
ছোট একটা রেস্তোরাঁয় আমরা তিনজন ঢুকে পড়লাম। বাংলাদেশের দুই হাজার টাকায় তিনজনের রাতের খাওয়া শেষ। তিনটি পদ। সঙ্গে চা। শুধু মারাক্কেশ নয়, কাসাব্লাংকা, ইছাওরা, আগাদির সব শহরেই, অনায়াসে রাস্তার পাশের ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকে সহনীয় দামে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। এমনকি এটলাস পাহাড়ের চূড়ার ছোট গ্রামেও একাধিক ছোট রেস্তোরাঁ আছে। অসংখ্য পর্যটক চোখ বুজে কোনো সংশয় ছাড়াই সেখানে সকাল-দুপুর-রাত্রি খেয়ে যাচ্ছেন। এসব রেস্তোরাঁর সব কটিই ছোটখাটো। কোনো আতিশয্য নেই। ভেতরটা পরিষ্কার। দাম সহনীয়। খেতে বসে রান্না করার জায়গাটা দেখা যায়। দশ দিন মরক্কোর একাধিক শহরের ছোটখাটো, বলতে গেলে, রাস্তার পাশের দোকান থেকে খেয়েও বিন্দুমাত্র শরীর খারাপ হয়নি আমাদের কারও।

বছরে মরক্কোতে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ পর্যটক ঘুরতে যায়। এদের অধিকাংশই রাস্তার পাশের আড়ম্বরহীন ছোটখাটো রেস্তোরাঁয় খাওয়াদাওয়া সারে।

আসলে খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসের সঙ্গে একটা জাতির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি জড়িত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে রান্নার কৌশলগুলো ছড়িয়ে পড়ে। মিশে থাকে ভিন্ন সংস্কৃতি বা আচার আত্তীকরণের ইতিহাস। অনেক সময় ভিনদেশি, শাসক আর দখলদারদের। মরক্কোর কথাই ধরুন। সপ্তম শতাব্দীতে আরবদের আগমন বদলে দিয়েছিল স্থানীয়দের খাদ্যাভ্যাস, যা এখনো চলছে। আরবরা চীন, ভারত আর মালয়েশিয়া থেকে আদা, গরমমসলা, হলুদ আর জিরার সঙ্গে মরক্কানদের পরিচয় করিয়ে দেন।

বড় হোটেল–রেস্তোরাঁগুলো বিশ্বের সব শহরে প্রায় একই রকম খাবার পরিবেশন করে। ছোটখাটো রেস্তোরাঁ, যেখানে স্থানীয় লোকেরা খাওয়াদাওয়া সারে, তার পরিবেশ থেকে অনেক কিছুই জানা যায়। একটা জাতির রুচি, আচার, সামগ্রিক পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, অন্যের প্রতি দায়বদ্ধতা, এমনকি সততা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় কোনো শহরের ছোট রেস্তোরাঁ থেকে।

উত্তর আফ্রিকা বাংলাদেশ থেকে অনেক দূর। কাছের দেশগুলো দেখুন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় সব দেশে—থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সহনীয় দামে খাবার পাওয়া যায়। ব্যাংককের রাস্তার ধারের ছোট রেস্তোরাঁগুলোয় খাওয়ার সময় দীর্ঘ লাইন পড়ে। কোনো সংশয় ছাড়াই এসব জায়গায় অনায়াসে খাওয়া যায়। দামটাও হাতের নাগালে। একজন সাধারণ গৃহবধূ স্বাস্থ্যবিধি আর পরিচ্ছন্নতা মেনে খাবার রান্না এবং পরিবেশন করেন। বিদেশি পর্যটক থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষ দিনের অধিকাংশ খাওয়াদাওয়া এসব রেস্তোরাঁয় করে থাকে।

খাবারটা ভালো হলে, পচা-বাসি না হলে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশে রান্না হলে, চেয়ার আর টেবিল ছাড়া ভিড় বাড়াতে অন্য কিছু আর লাগে না। কিন্তু আমরা পারছি না কেন? বাংলাদেশের ছোট-বড় সব শহরে পরিচ্ছন্ন পরিবেশে, সহনীয় দামে রেস্তোরাঁর খাবার পাওয়া একটা বড় সমস্যা। খাবারের মানটা ভালো হলে দাম অনেক বেশি। লন্ডনে বাংলাদেশি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় আপনি মোটামুটিভাবে খেতে পারবেন—সকাল, দুপুর বা রাতের যেকোনো খাবার। বলে রাখি, লন্ডনে প্রতি ঘণ্টার ন্যূনতম বেতন ১ হাজার টাকার মতো। অর্থাৎ আধা ঘণ্টার উপার্জন দিয়ে এক বেলার খাবার খাওয়া যায়।

৭০০ থেকে ১ হাজার টাকায় পৃথিবীর অনেক শহরে সব কটি মহাদেশে এক বেলার খাওয়া আমি খেয়েছি। তাহলে আমরা পারছি না কেন? পরিকাঠামো, দ্রব্যমূল্যে হয়তো কিছুটা ব্যবধান আছে। কিন্তু রান্না করার পরিবেশ, খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণ তো আমাদের হাতেই। সরকারের স্থানীয় সংস্থাগুলো যত চেষ্টাই করুক না কেন, মানসিকতার পরিবর্তন আর সদিচ্ছা না থাকলে খাবারের মান উন্নত করা যাবে না। কথায় কথায় আমরা বিশ্ব জয় করার কথা বলি। বিশ্ব জয় করার আগে নিজেদের ছোটখাটো লোভগুলো জয় করে মানুষকে একবেলা, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে, নির্ভেজাল খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করা উচিত। ভুলে গেলে চলবে না, শুধু খাবারের জন্যই মানুষ দেশ থেকে দেশান্তরে গিয়েছে, গড়ে উঠেছে সভ্যতা।

ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]