সবার টিকা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ দরকার

করোনায় বাড়ছে মৃত্যু, বিপর্যস্ত অর্থনীতি। এই পরিস্থিতিতে গতকাল যুক্তরাজ্যে শুরু হয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি–৭–এর শীর্ষ সম্মেলন। এসব নিয়ে প্রথম আলোতে লিখেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস ও কমনওয়েলথের মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড

তেদরোস গেব্রেয়াসুস, প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারির প্রভাবের দিকে তাকালে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়: আমরা সবাই একই ঝড়ে কবলিত, যদিও আমরা সবাই একই নৌকার আরোহী নই।

ধনী দেশগুলো যেখানে করোনার টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু করেছে, তখন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত এবং ক্যারিবীয় ও লাতিন আমেরিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকর্মীরা এখনো টিকার প্রথম ডোজ পেতে অপেক্ষায় রয়েছেন। করোনা পরীক্ষার সক্ষমতাও তাঁদের পর্যাপ্ত নয়। অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ পিপিই ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।

যদিও বেদনাদায়ক সত্যটা হলো, এসব অসমতা সত্ত্বেও আমরা সবাই কোভিড–১৯ এবং এই ভাইরাসের নতুন নতুন ধরনগুলোর সমান হুমকিতে রয়েছি।

উচ্চ আয়ের দেশগুলোর নিজেদের শ্রমজীবীদের রক্ষায় এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে। কিন্তু কম সমৃদ্ধ অর্থনীতিগুলোকে মহামারির অর্থনৈতিক ধাক্কা মোকাবিলা করতে গিয়ে ধুঁকতে হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ঋণ। ফলে এই সংকট তাদের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎকে হুমকিতে ফেলছে।

বিশ্বের অর্ধেক জনগোষ্ঠী যখন কোভিড–১৯–এর আতঙ্কের মধ্যে এবং অনেক দেশেই যখন লকডাউনের পর লকডাউন দিতে হচ্ছে, তখন এটা ভাবা অর্থহীন যে জি–৭ (শিল্পোন্নত সাত দেশ)সহ পুরো বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধির পথে ফিরবে। এই সংকটের স্বল্পমেয়াদি প্রভাব এবং তার সমাধানই আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব আমাদের সবার জীবনের জন্য হুমকি হয়ে আছে।

এই বড় বিষয়গুলোর কারণে সৃষ্ট সংকটের কারণেই নিজ স্বার্থে জি–৭ ও অন্য ধনী দেশগুলোর উচিত পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এমন একটি চুক্তিতে পৌঁছানো, যা বিশ্বকে পথ দেখাবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সব দেশের প্রতি আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর কমপক্ষে ১০ শতাংশকে এবং ডিসেম্বর সামনে রেখে জোরদার উদ্যোগ নিয়ে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য অর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একই ধরনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে বৈশ্বিক টিকাদান ৬০ শতাংশ নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ করলে বৈশ্বিক অর্থনীতি সেই বিনিয়োগের ৩৫ গুণ ফিরে পাবে। যেকোনো বাজারে এই মুনাফা বিস্ময়কর—এতে কর্মসংস্থান ও জীবন রক্ষা যেমন হবে, স্বাস্থ্যগত লোকসানও এড়ানো যাবে।

কোভিড–১৯ মোকাবিলায় ২০২২ সাল নাগাদ বৈশ্বিক টিকাদানের বিষয়ে যুক্তরাজ্য সম্প্রতি যে সাড়া দিয়েছে, তা একটি আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি। বিশ্বের সবাইকে টিকা দেওয়ার বিষয়টি কেবল যুক্তিসংগতই নয়, এটি এমন একটি লাভজনক আর্থিক বিনিয়োগ, যেকোনো দেশের সরকার সেটি করতে পারে।

করোনার নতুন ধরনগুলোর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি আমাদের সবার জন্য সতর্কবার্তা। বর্তমানে চাপে থাকা দেশগুলোর টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আমাদের অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে।

একই সঙ্গে আমাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে আফ্রিকা ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী যেন টিকা পায়। আমরা যদি এই মহামারির সমাপ্তি ঘটাতে চাই এবং এই ভাইরাস থেকে নিজেদের রক্ষা করতে চাই, তাহলে একটাই সমাধান: অবশ্যই টিকা সুলভ করতে হবে এবং বিশ্বের সবার টিকাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ করতে হবে।

বৈশ্বিক বিনিয়োগের তিনটি মাত্রা। প্রথমত, ২০২২ সাল শেষ হওয়ার আগে যেকোনো স্থানের যে কেউ যেন টিকা পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে; দ্বিতীয়ত, বিশ্ব যেন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করতে পারে, যা আমাদের সমৃদ্ধিকে আরও জোরালো করবে; এবং তৃতীয়ত, টিকে থাকার জন্য আমরা যদি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে করে আমরা একসঙ্গে জলবায়ু সংকট মোকাবিলা করতে পারি।

জি–৭ নেতারা যখন বৈঠক করবেন, তাঁদের মাথায় রাখতে হবে যে বৈশ্বিক পরিস্থিতি পরিবর্তন এবং টিকা সমতা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক ও উৎপাদন সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে। বৈশ্বিক উদ্যোগ, বিশেষত অ্যাকসেস টু কোভিড–১৯ টুলস অ্যাকসিলারেটর এবং কোভ্যাক্স কর্মসূচির জন্য তাঁদের সমর্থন অত্যন্ত জরুরি।

জি–৭ বৈঠকের প্রাক্কালে বাকি বিশ্ব তাঁদের দিকে এই নিশ্চয়তা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে যে নিজেদের জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার পাশাপাশি পুরো বিশ্বের সুরক্ষা এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের ক্ষমতা রয়েছে এই নেতাদের।