সব্বে সত্তা সুখিতা...

মাধবকুণ্ডের প্রকৃতি
মাধবকুণ্ডের প্রকৃতি

‘এই যে বাংলাদেশ ইহার মৃত্তিকা, ইহার জল, ইহার বায়ু, ইহার আকাশ, ইহার বন, ইহার শস্যক্ষেত্র লইয়া আমাদিগকে সর্বতোভাবে বেষ্টন করিয়া আছে...আমরা যেন ভালোবাসিয়া তাহার মৃত্তিকাকে উর্বর করি, তাহার জলকে নির্মল করি, তাহার বায়ুকে নিরাময় করি, তাহার বনস্থলীকে ফলপুষ্পবতী করিয়া তুলি, তাহার নরনারীকে মনুষ্যত্ব লাভে সাহায্য করি।’—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

গত ২২ মে জীববৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে দৈনিক প্রথম আলো যে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করেছিল তার আলোচ্য বিষয় ছিল ‘পানি-নিরাময় ও জীববৈচিত্র্য’। সেখানে উপস্থিত উদ্ভিদ, প্রাণী, বন, জলাভূমি, পানি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথের উপরিউক্ত কথাগুলোরই যেন প্রতিধ্বনি শুনছিলাম আর মনে পড়ছিল কৈশোরের স্মৃতিজড়িত মাধবকুণ্ড ও সংলগ্ন পাথারিয়া পাহাড়ের বনাঞ্চলের কথা। ছেলেবেলায় অনেকটা সময় কেটেছে ওখানে, আমাদের বাগানবাড়িতে। বাড়িটি আজও আছে, তবে বদলে গেছে অনেক কিছু। আগে লোকজন ছিল না, এখন সেখানে মস্ত বসতি।

সত্তর বছর বা আরও আগের কথা। গ্রামের বাড়ি থেকে ঘণ্টা দুই হেঁটে ওখানে পৌঁছাতাম। কখনো মায়ের সঙ্গে, কখনো অন্য কারও। ওদিকে মাইল খানেক এগোলেই বনেঢাকা গ্রাম, পথপাশ লতাগুল্মে ঠাসা, তাতে নানা রঙের ফুল, পথজুড়ে বসে থাকা বানরের দল, সহজে নড়তে চাইত না। আরও ঘণ্টা খানেক হেঁটে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাতাম। চারদিকে উঁচু উঁচু টিলায় অজস্র গাছগাছালি— রামকটা, আকুশ, ধারমারা, বনচালতা, ছেলপই, করই, চাম্বল, লক্ষ্মীআম, আমলকী ও অশোক আরও অনেক জাতের বাঁশ। বুনো জন্তুর মধ্যে শূকর, হনুমান, উল্লুক, শজারু, বনরুই, মায়াহরিণ, সম্বর, মেছোবাঘ, সম্ভবত রামকুত্তাও। শীতের মৌসুমে ফাঁদে দু-একটা বাঘও ধরা পড়ত, আমরা স্কুল থেকে দলবেঁধে দেখতে যেতাম। একবার একটা ঢাউস স্থলকচ্ছপও পেয়েছিলাম, দেখেছি পৃথিবীর দীর্ঘতম বিষধর সাপ শঙ্খচূড়। অগুনতি জাতের পাখি ছিল—বনমোরগ, তিতির, ডাহুক, ময়না, হরিয়াল, টিয়া, ভিমরাজ, আলতাপরী আর রংবেরঙের অজস্র ছোট ছোট পাখি। টিলার নিচের ছড়া বহতা থাকত সারা বছর, আমরা হাতড়ে হাতড়ে কুচোমাছ ধরতাম। ছড়ার পারে ছিল বুনো লেবুর অনেকগুলো ঝাড় আর বনে উচ্ছে ও কাঁকরোল।

পঞ্চাশের দশকের শেষ নাগাদ পাহাড়ের মুলিবাঁশের বন ফল ফলিয়ে মরে গেলে ঝরে পড়া ফল থেকে আবার বনের পুনর্জনন ঘটে। পাকিস্তানি আমলে একসময় বনে লুটেরাদের হামলা শুরু হয়। স্বাধীনতার পর নতুন সড়ক, গ্রামীণ বিদ্যুৎ, করাতকল, ইটভাটা ইত্যাদি উন্নয়নের সমান্তরালে সেই লুটেরাদের উপদ্রব বৃদ্ধি পেতে পেতে দশককালের মধ্যে বনটি বৃক্ষহীন হয়ে পড়ে। লোপ পায় তার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য, শুকিয়ে যেতে থাকে পাহাড়ি ছড়াগুলো।

একুশ শতকের শুরুতে বাঁশবনে আবার ফল ধরে আর যথারীতি মারা যায় সবগুলো বাঁশ। কিন্তু এবার আর পুনর্জননের সুযোগ মেলে না, প্রাকৃতিক বনের পরিবর্তে আসে সামাজিক বনায়নের ব্যবস্থাপত্র। উঁচু উঁচু টিলা ভরে উঠতে থাকে আগর আর অ্যাকাশিয়াগাছে। এভাবে একটি প্রাকৃতিক বনের মৃত্যু ঘটল, ধ্বংস হয়ে গেল পুরো একটা প্রাণীকুল। এখন আমাদের বাগানবাড়ি যেতে আর দু-তিন ঘণ্টা হাঁটতে হয় না, রিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন মেলে। সর্বত্র মানুষ, বদলে গেছে গোটা দৃশ্যপট। বাস্তুসংস্থানের মনুষ্যসৃষ্ট এই অবক্ষয়ের পরিণতি এখন আর অননুমেয় নয়। প্রাকৃতিক বনের বদলে সামাজিক বন সৃজন নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিকেরা নিজ নিজ কাগজে ফলাও প্রতিবাদ পাঠিয়েছিলেন, কোনো ফল ফলেনি। প্রশাসন নির্বিকার। এই উদাসীনতা বা অবহেলা নতুন কিছু নয়। শতবর্ষ আগেই বিজ্ঞানীরা কার্বন ডাই-অক্সাইডের তাপবর্ধক বৈশিষ্ট্যের কথা জানিয়েছিলেন, কেউ তা আমলে নেয়নি। ফলে আজকের বিশ্ব-উষ্ণায়ন, সমুদ্রস্ফীতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের আলামত।

প্রথম আলোর সেদিনের গোলটেবিল আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত বক্তারা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যথাযথ প্রশাসনিক উদ্যোগ ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। বলা বাহুল্য, এটুকু বাস্তবায়িত হলেই পাথারিয়া পাহাড়ের বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পেত, ছড়াগুলো শুকিয়ে মরে যেত না, মুলিবাঁশের চক্রাকার পুনর্জনন ঘটত। কিন্তু গোটা সমস্যাটা আরও ব্যাপক ও জটিল। পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন আর এই অসুখের উৎস খোদ মানুষ, তার প্রকৃতি জয়ের অদম্য বাসনা।

কিন্তু এই বাসনা পূর্ণ হওয়ার নয়। মানুষ এখন জড়িয়ে পড়ছে প্রকৃতির পাতা ফাঁদে। কৌশলগত পশ্চাদপসরণের সুযোগও তার নেই, তাতে অর্থনীতির অনিবার্য বিপর্যয় ঘটবে, বিশ্বের বিদ্যমান স্থিতাবস্থায় নামবে ধস। তাই ধরিত্রী সম্মেলনগুলোতে চলছে সাময়িক উপশমের জন্য দর-কষাকষি, নেই স্থায়ী আরোগ্যের উদ্যোগ। ইতিমধ্যে আমরা পৃথিবীর সব সম্পদকে পণ্যে রূপান্তরিত করেছি, ভালোবাসার জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখিনি। আজকের পৃথিবীতে ‘সকল সত্তা সুখী হোক’ এমন উচ্চারণ, হোক তা জীববৈচিত্র্য দিবসের আশ্রয়বাক্য, বড়ই নিরর্থক শোনায়।

দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।