সমঝোতার বিকল্প নেই

১০টা হোন্ডা, ২০টা গুন্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা—নিঃসন্দেহে এমন যুগ পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। কালোটাকা, পেশিশক্তি, ধর্মের ব্যবহার এখনো প্রভাব ফেলছে বটে, কিন্তু দিনবদলের প্রতিধ্বনিও আছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার টানতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কখনো কখনো ধর্মীয় বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল-সমর্থক প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচন ঘিরে টাকার ছড়াছড়ি, টাকা দিয়ে ভোট কেনাবেচা, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন—এমন জোরালো কোনো অভিযোগ ওঠেনি।
সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধেই আচরণবিধি লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ ছিল না। ক্ষমতাসীন দল-সমর্থিত প্রার্থীদের প্রতি নির্বাচন কমিশন পক্ষপাত দেখাচ্ছে, প্রচারণার সময় মাঝেমধ্যে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা ধোপে টেকেনি।
গত ১৫ জুন অনুষ্ঠিত রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট—গুরুত্বপূর্ণ এই চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন ছিল বর্তমান সরকারের আমলে গঠিত নতুন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রথম বড় পরীক্ষা। ওই নির্বাচনের আগে ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছিল বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। পরে অবশ্য বরফ গলেছে, বিএনপি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে। এমনকি গত ১৫ জুলাই চার সিটি নির্বাচনের পর রাতে ফল ঘোষণায় কালক্ষেপণ করা হচ্ছে—এমন উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে মুঠোফোনে নির্বাচন কমিশনার আবু হাফিজের সঙ্গে কথা বলেন খালেদা জিয়া। ওই সময় নির্বাচন কমিশন থেকে তাঁকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল। গাজীপুর সিটি নির্বাচনের ফল ঘোষণার সময়ও আরেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ শাহনেওয়াজের সঙ্গেও একই বিষয়ে কথা বলেন তিনি।
পাঁচটি সিটি নির্বাচনের আগে সুশীল সমাজসহ দেশের সাধারণ মানুষও নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয়মুক্ত ছিল না। শেষ পর্যন্ত চার সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে ইসি। এরপর গত ৬ জুলাই নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও নিরপেক্ষতা ও আস্থার পরীক্ষায় উতরে গেছে ইসি। দুই নির্বাচনেই ব্যালট বাক্স ছিনতাই, জাল ভোট প্রদান, ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটদানে বাধা দেওয়া, কেন্দ্র থেকে বিরোধী দল-সমর্থিত প্রার্থীদের এজেন্টকে বের করে দেওয়া, ফল ঘোষণায় চাতুরতার আশ্রয় নেওয়া, সরকারি প্রভাবে ফল পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা—এমন নজির দেখা যায়নি। ধীরে হলেও নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুণগত উত্তরণ দেখা গেছে সাম্প্রতিক সময়ে। স্থানীয় নির্বাচন হলেও প্রচারণা এবং ফল ঘোষণার পর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাজনীতিতে ‘নতুন দিনের’ ইঙ্গিত দিচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে কোণঠাসা করতে ব্যক্তিগত আক্রমণ, কুৎসা রটানোর ঘটনাও তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোটের আগের রাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে হুমকি দেওয়ার ঘটনাও খুব একটা দেখা যায়নি।
বিশেষ করে চার সিটি নির্বাচনের পর দিন রাজশাহী, খুলনা ও সিলেটে সরকার-সমর্থক পরাজিত মেয়র প্রার্থীদের বাসায় গিয়ে নির্বাচিত মেয়রদের শুভেচ্ছা বিনিময় এবং নিজ এলাকার উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিনির্মাণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সর্বশেষ গাজীপুর সিটি নির্বাচনের পরও এই সম্প্রীতি দেখা গেছে। নির্বাচনের পরদিন পরাজিত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লার বাসভবনে যান নির্বাচিত মেয়র এম এ মান্নান। দুজনের মধ্যে মুঠোফোনেও কথা হয়।
বেশ কয়েক বছর ধরে সরকার ও বিরোধী পক্ষের নেতাদের মধ্যে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, রেষারেষি প্রায় ‘অসুস্থ’ পর্যায়ে চলে গেছে। এই বিরোধ শীর্ষ পর্যায় থেকে একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। কোনো সামাজিক আয়োজনে বিরোধী পক্ষের কোনো নেতার উপস্থিত থাকার সম্ভাবনা থাকলে অন্য পক্ষ সেখানে পারতপক্ষে অংশ নিতে চাইত না। কারও মৃত্যুর পর ‘জানাজার’ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতাদের একসঙ্গে দেখা হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
গত ২৯ জুন সংসদের বাজেট অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৬৫৪টি নির্বাচনে ৬৪ হাজার ৭৬৬ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। প্রতিটি নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। আমার এত দিনের সংগ্রাম সার্থক হয়েছে। এখন গণতন্ত্রের পথে পা বাড়াতে হবে। গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা না থাকলে দেশে উন্নয়ন হবে না।’
একই দিন দেওয়া বক্তৃতায় বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এই সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচন নিয়ে গুরুতর কোনো অভিযোগ করেননি। তিনি বলেন, ‘সব মতকে সমন্বিত করে বৈচিত্র্যের মধ্যেই আমাদেরকে জাতীয় ঐক্যের সন্ধান করতে হবে। দেশের মানুষ দ্বন্দ্ব, সংঘাত, বিভেদ, বিভাজন চায় না।’ স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল-সমর্থকদের একের পর এক বড় পরাজয় সত্ত্বেও সরকার তা ‘হজম’ করে গেছে। ফল পাল্টানোর চেষ্টা না করে সরকার জনরায় সহজভাবেই মেনে নিচ্ছে—অতীত অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে এটিও রাজনীতিতে শুভ দিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রধান দুই দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে কি না, এ নিয়ে নানা মহলে অনিশ্চয়তা থাকলেও বিএনপির সাম্প্রতিক অবস্থান কিছুটা হলেও তা দূর করেছে। ৯ জুলাই প্রথম আলোর শীর্ষ প্রতিবেদনে বিএনপি সূত্রের বরাত দিয়ে লেখা হয়েছে, ‘সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জোট তাদের দাবিতে ছাড় দিতেও প্রস্তুত আছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের ব্যাপারে একটি সম্মানজনক সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে নির্বাচন কমিশনের ব্যাপারে কোনো আপত্তি না তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলীয় চেয়ারপারসন তাঁদের বলেছেন, নির্বাচনের আগে কোনো না কোনো সমঝোতা হবে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির সামনে নির্বাচন ছাড়া অন্য বিকল্প নেই।
এসব ‘আলামত’ রাজনীতিতে নতুন দিনেরই ইঙ্গিত।
ইমাম হোসেন সাঈদ: সাংবাদিক।