সাংবাদিকের গোয়েন্দাগিরি ও অনিয়মের প্রতিবেদন


গোয়েন্দা কাহিনি পড়া আর নিজে গোয়েন্দাগিরি করা—এই দুইয়ের মধ্যে যে দুস্তর ব্যবধান, তা এবার ভালোভাবে বুঝেছি। পেশাগত কাজে একবার গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম। উদ্দেশ্য ছিল বন্দরে অবৈধভাবে কিছু অসাধু আমদানিকারক ‘মিক্সচার লরি’ বাংলাদেশে এনে ট্রাক হিসেবে বাজারজাত করছে—তার ওপর প্রতিবেদন করা। কারণ এই ধরনের আমদানির ফলে দেশ দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রথমত, মিক্সচার লরি আমদানির জন্য সরকারকে কোনো শুল্ক দিতে হয় না। কারণ এটি অবকাঠামো নির্মাণ শিল্পের একটি প্রয়োজনীয় সহায়ক উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। দুই, বিপরীতে এর জন্য কোনো বয়সসীমা নেই। অর্থাৎ বেশ পুরোনো মিক্সচার লরি আমদানি করা যাবে। এই মিক্সচার লরিকে ট্রাকে রূপান্তরের ফলে প্রথমত, সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পরিবেশের জন্য তা মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ঢাকা থেকে বিপুল উৎসাহ নিয়ে চট্টগ্রাম যাওয়ার পর প্রায় চুপসে গেলাম। কারণ যাঁরা সহযোগিতার কথা বলেছিলেন তাঁদের আলাপচারিতায় ভয় পেয়ে গেলাম। তাঁরা বললেন, সাংবাদিক হিসেবে আমাকে বন্দরে ঢোকানো যাবে না। আর ঢুকলেও আমি কোনো তথ্য পাব না। আমার সঙ্গে কেউ কথা বলবে না।

তাঁদের এই আশঙ্কার কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করলাম। ভয় আমাকে তাড়া করতে থাকল। আমরা সিএনজিচালিত একটি বাহনে করে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে যাচ্ছিলাম। মাঝখানে আমি। আমার দুই পাশে দুই সাথি। আমার সঙ্গে ওয়ালেটে ভিজিটিং কার্ড। বুক পকেটে পরিচয়পত্র। আমি যে সাংবাদিক তা চিহ্নিত করা মোটেই কঠিন নয়। আমাদের গাড়ি একসময় এসে থামল গেটে। আগে থেকেই বন্দোবস্ত করা ছিল গেট পাসের। আমরা তিনজন বন্দরে ঢুকে পড়লাম।

গেটেই আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন এক আমদানিকারক। সাথিরা আমাকে আমদানিকারকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার সম্পর্কে তাঁদের কাছে বলা হলো, আমার ঢাকায় বড় ব্যবসা রয়েছে—পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা। বেশ কয়েকটি ট্রাক দরকার। কিন্তু ট্রাকের যে দাম! তাই মিক্সচার লরি কিনতে চাই। অতি উৎসাহে আমদানিকারক বন্দরের ভেতরে নিয়ে মিক্সচার লরি দেখাতে শুরু করলেন। একজন সম্ভাবনাময় ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য যেভাবে পণ্যের গুণ তুলে ধরা দরকার, তার সবটুকুই তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে করলেন। কীভাবে এই মিক্সচার লরি ট্রাক হিসেবে রেজিস্ট্রেশন পায়, সে পথ বাতলে দিলেন। ওই কাজগুলো তাঁরাই করে দেবেন। শুধু প্রয়োজন হবে মোটা অঙ্কের টাকার। আমাদের পথপ্রদর্শক শিক্ষিত আমদানিকারক বললেন, ‘বুঝলেন না, ওটা হলো স্পিড মানি’।
ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে ধাতস্থ করতে কিছু সময় লাগল। এরপর আস্তে আস্তে কথা ফুটতে থাকে। তবে আমার চেয়ে সাথিরা ছিলেন চটপটে, বলিষ্ঠ। আমার ব্যবসায়ের সব বর্ণনা তাঁদের মুখস্থ। কথা বলতে বলতে আমদানিকারক ভদ্রলোক আমার আপন হয়ে গেলেন। বললেন, ‘জানেন, একবার এ রকম এক ব্যবসায়ী এসেছিলেন। তারপর সেটা একদিন কাগজে রিপোর্ট হয়ে গেল। দেখুন তো কী সর্বনেশে ব্যাপার! ওটা সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল আমাদের। এ তো রিপোর্ট নয়, পেটে লাথি মারা।

এসব নিখাদ তথ্য নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম দুদিন পর। কয়েক দিনের মধ্যেই রিপোর্ট ছাপা হয়ে গেল, বিষয়বস্তুর কারণে যথেষ্ট গুরুত্বসহকারে। কিন্তু রিপোর্ট করার সময় আমার মধ্যে প্রশ্ন আর সংশয় ছিল, আমি কি অন্যায় করছি? আমি কি পরিচয় লুকিয়ে রেখে নৈতিকতার স্খলন করছি?

ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবীণ সাংবাদিক আরনল্ড জিটলিগ বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহচর্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তিনি তাঁর পেশার বিচিত্র সব কাহিনি শুনিয়ে যান। তাঁর মধ্যে একটি ছিল এ রকম—নাইজেরিয়ার সামরিক বাহিনীর এক ঘরোয়া সভায় তিনি উপস্থিত ছিলেন একজন সম্মানিত অতিথি হিসেবে। ওই সময় তিনি নাইজেরিয়ায় আমেরিকান সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) হয়ে কাজ করতেন। সেই সুবাদে একজন পদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর সখ্য হয়। অধস্তন সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে এ জন্য সম্মানের চোখে দেখতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁর মূল পরিচয় জানতেন না। আরনল্ড জিটলিগ ওই সভার একটি সংবেদনশীল সিদ্ধান্ত একান্ত সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করেন। আর ওই সংবাদ নিয়ে হইচই পড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে জিটলিগ বলেন, ‘আমার কাছে আজও এই প্রশ্ন মনে জাগে যে এভাবে নিজের পরিচয় লুকিয়ে রেখে আমি যে সংবাদ সংগ্রহ করেছিলাম, সেটি কি নৈতিকতার প্রশ্নে বিদ্ধ?’

এখন প্রশ্ন হচ্ছে নিজের চোখে না দেখে কেবল বর্ণনা আর ধারণা কিংবা দলিলপত্র দেখে সংবাদ তৈরি করবেন? মিক্সচার লরির সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আজ আমি যেভাবে নিজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ নৈতিকতার বেড়াজালে—এই প্রশ্ন কি একইভাবে সবাইকে বিদ্ধ করে? কোনটি ন্যায়? আমার দেখা নাকি না দেখে কল্পনাশক্তি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা? আমরা নিজের উপলব্ধির জন্য সেদিন চট্টগ্রাম বন্দরে যা নিজের চোখে দেখেছি, তা ছিল এই সংবাদের জন্য অপরিহার্য। আর সেই অনিবার্য সত্য নিয়ে কেন তাহলে নৈতিকতার প্রশ্ন আমাকে ক্ষতবিক্ষত করবে?

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রে রয়টার্সের সদর দপ্তরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ওপর পরপর অনেকগুলো রিপোর্টিংয়ের সুবাদে ওই বছর দ্য সোসাইটি অব পাবলিশার্স ইন এশিয়ার (সোপা) এডিটরস এক্সেলেন্স ক্যাটাগরিতে অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সেলেন্স লাভ করি। হংকং বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তিত এই পুরস্কার এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সাংবাদিকদের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে রয়টার্সের সদর দপ্তরের কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটে। নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে রয়টার্সের সদর দপ্তর পরিদর্শনকালে সংবাদ সংস্থার এডিটর ইনচার্জ রয়টার্সের গ্লোবাল এডিটর এথিক্স্ অ্যান্ড স্টাডিজ এলিক্স এম ফ্রিডম্যানের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ ও মতবিনিময়ের সুযোগ ঘটে। এই সাক্ষাৎ আমি আমার পেশাগত জীবনের জন্য এক বিরল সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করি।

সুযোগ বুঝে আমি এলিক্সকে চট্টগ্রাম বন্দরে আমার গোয়েন্দাবৃত্তির অভিজ্ঞতা পেশ করলাম। তিনি পুরো ঘটনা যত্নসহকারে শুনলেন। তবে ভবিষ্যতে এ ধরনের চর্চার বিরুদ্ধে শতবার ভেবে নিতে বললেন, নিজের সাংবাদিকতার সুযোগ তৈরির জন্য এভাবে তথ্য সংগ্রহ এবং তার ভিত্তিতে প্রতিবেদন রচনা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং রয়টার্সের মানসম্মত নীতিমালার পরিপন্থী।

সিরাজুল ইসলাম কাদির রয়টার্সের সাবেক ব্যুরোপ্রধান এবং বর্তমানে আমেরিকান চেম্বার কমার্সের নির্বাহী সম্পাদক
serajulquadir 26879 @gmail. com