সাকিব আসলেই অলরাউন্ডার!

সাকিব আল হাসান
সাকিব আল হাসান

একটা গ্রামীণ কৌতুক এ রকম: মফিজ মিয়াকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। কেন? না, মফিজ মিয়া বউ পেটায় না। যে বউ পেটায় না সে তো পুরুষ নামের কলঙ্ক। মফিজ মিয়া ভেবে পায় না, যে বউকে সে এত ভালোবাসে তার গায়ে খামোখা হাত তুলবে কেন? কিন্তু মানুষজন টিটকারি করতে ছাড়ে না দেখে একদিন নিরুপায় হয়ে বাড়ির সবার সামনে বেড়া থেকে একটা পাটকাঠি ভেঙে এনে সে বউকে ঠুকঠুক করে দুটো বাড়ি দিল। ওতেই পলকা পাটকাঠি গেল ভেঙে। তখন মফিজ মিয়া বাহাদুরি করে সবাইকে ভাঙা কাঠি দেখিয়ে বলে বেড়াতে লাগল—এবার দেখো সবাই, মফিজ নাকি বউ পেটায় না? পেটাতে পেটাতে আমি লাঠি ভেঙে ফেলেছি!

এক উচ্চশিক্ষিত সংস্কৃতিমান ফেসবুক বন্ধু ঈদের স্ট্যাটাস দিতে গিয়ে কাপড় ইস্তিরির ছবি আপলোড করে লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় সারা রাত কয়লার আগুনে কাপড় ইস্তিরিও ঈদ আনন্দেরই অংশ ছিল।’ ইস্তিরি করা কাপড়টিকে শাড়ির মতো দেখতে লাগায় তার এক বন্ধু লাইক দিয়ে লিখল ‘মনে হচ্ছে স্ত্রীর শাড়ি ইস্তিরি করছ?’ আর যাবে কোথায়? সংস্কৃতিমানের পৌরুষে এমন ঘা লাগল যে তিনি তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ‘ওটা মোটেই শাড়ি না। আমি কি স্ত্রৈণ?’

এসব মনোভঙ্গি নিয়েই আছেন আমাদের গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষিত মানুষেরা।

ছোটবেলায় আরও একটি কৌতুক আমরা ‘অতি লোভে তাঁতি নষ্ট’ বা এ ধরনের নীতিকথামূলক গল্পে পেয়েছি। এক দরিদ্র যুবক চাষির একটিমাত্র গাভি ছিল। সে দুধ থেকে ঘি বানিয়ে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখত। রোজ একটু একটু করে দুধের সর তুলে সে তার শিকেয় ঝোলানো ঘিয়ের ভাণ্ড প্রায় পূর্ণ করে ফেলে। বিড়াল তাড়ানোর জন্য লাঠি হাতে নিয়ে সে ঘুমাতে যায়। স্বপ্ন দেখে ঘি বিক্রি করে সে অনেক টাকা রোজগার করেছে। গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে বিয়ে করেছে। বউ তার কথার অবাধ্য হলে সে বউকে লাঠি দিয়ে সজোরে আঘাত করছে। ঘুম ভাঙলে সে দেখে তার হাতের লাঠির আঘাতে তার ঘিয়ের ভাণ্ড ভেঙে চুরমার।

এ ধরনের নীতিকথামূলক গল্পেও নারীর প্রতি পুরুষের দমনাত্মক চিত্রই প্রতিফলিত। আর পুরুষের তো অভিযোগ রয়েছেই, ‘আমার বউ কিছু করে না’। অনেকে আবার বউয়ের প্রশংসা করাকে পৌরুষের হানি ভাবেন। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘রাধে! স্ত্রী বুদ্ধি একেই বলে সাধে?’ যাহোক, আমাদের সাকিব আল হাসান অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে প্রথম টেস্টে জিতে কোটি কোটি দর্শকের সামনে বলেন, ‘গতকাল রাতে আমি আমার ওয়াইফকে বলেছিলাম যে আমরা মনে হয় এই ম্যাচটা জিততে পারব না। তখন আমার ওয়াইফ বলেছিল একমাত্র তুমিই আছ, যে পারে এই ম্যাচটা জেতাতে’। স্ত্রীর প্রতি সাকিবের সম্মান ও ভালোবাসার এমন উদাহরণ দেখে সেদিন অনেক নারীর চোখে আবেগের অশ্রু চিকচিক করেছিল।

এক ফেসবুক বন্ধু কবিতা লিখেছেন:

‘বউকে রান্নার কাজে সাহায্য করি তাই সমাজ আমাকে নাম দিয়েছে বউ পাগলা

বউ কাপড় কেচে দিলে আমি কাপড় রশিতে ছড়ায়ে দিই তাই সমাজ আমাকে নাম দিয়েছে হিজড়া

কোনো কাজ করার আগে বউয়ের সঙ্গে পরামর্শ করি তাই সমাজ আমার নাম দিয়েছে কাপুরুষ।’

এদিকে সমাজ গবেষকেরা বলেন, ‘তারাই সুখী পুরুষ, যারা স্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করে।’ তাই স্ত্রী বুদ্ধি নিয়ে কবিতার শুরুতে রবীন্দ্রনাথের সংশয় থাকলেও শেষে গিয়ে ভুল বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তত দিনে ক্ষতি যা তা হয়েই গেছে। সমমানের কাজ করেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই। দুজনের কাজই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে স্ত্রীর প্রশংসায় স্বামী বলেন, ‘আমার স্ত্রী খুব ভালো মোরগ পোলাও রাঁধেন’। ওদিকে গৃহব্যবস্থাপক স্ত্রীদের উচ্চপদস্থ স্বামীর পদোন্নতি আর বিদেশভ্রমণের গল্পের মধ্যে বাতাস ঢুকতে পারে না। সাকিব স্ত্রীদের সম্মান করতে শেখালেন। স্ত্রীকে রান্না করে খাওয়ানোর বিজ্ঞাপনে উৎসাহী হয়ে অভিনয় করলেন। খেলার পরে স্ত্রী-সন্তানকে সময় দেওয়ার কথাও সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলে থাকেন। সাকিব শুধু বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারই নন, সাকিব মানুষ হিসেবেও দৃষ্টান্ত।

সেলিব্রিটি বা তারকাদের আমরা আদর্শ ভাবি। তাই কোনো প্রণোদনামূলক অনুষ্ঠান আমরা তাঁদের দিয়ে উদ্বোধন করাই। কিন্তু সব তারকাই তো আর অনুকরণীয় নন। পুরুষতান্ত্রিকতার সুবিধা ত্যাগ করা আর স্বেচ্ছায় সিংহাসন ত্যাগ করা অনেকের কাছে সমান। অনেক পুরুষ কথায় ও কাজে ভিন্ন মানুষ। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বাইরে কাজ করেন, বাড়ির ভেতরে একজন নারী নিপীড়ক। অনেকে কৃতিত্ব নেন এই বলে যে আমি রান্নাঘরে আমার স্ত্রীকে সাহায্য করি। যেন রান্নাঘরটা স্ত্রীর বিভাগ। স্বামী সাহায্য করে স্ত্রীর চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিয়েছেন। ফেসবুকের উল্লিখিত কবিতাটির মতো বউ কাপড় কেচে দিলে আমি কাপড় রশিতে ছড়ায়ে দিই। কবি কৃতিত্ব নিতে গেছেন সহযোগী স্বামীর। মাথার কোষে আটকানো আছে কাপড় কাচা-ধোয়া-মেলা বউয়ের কাজ। তিনি কাপড় মেলে দিয়ে বাহাদুরি নিচ্ছেন কিন্তু বেশি পরিশ্রমের অংশ কাপড় কাচার বিষয়টা তাঁর মাথাতেই আসেনি। যাক, তবু মন্দের ভালো।

চারদিকে সাজসাজ রব। শারদীয়া দেবী দুর্গা আসছেন। এক সাংবাদিক-কবি স্বামী তাঁর সাংবাদিক-লেখক স্ত্রীর ছবি পোস্ট করেছেন ফেসবুকে। ছবিটাতে ঘাড়ে ব্যাগ এবং দুহাতে কাঁচাবাজারের দুই পেল্লাই ঝোলা নিয়ে স্ত্রী ব্যস্ত রাস্তা পার হচ্ছেন। স্বামী গাড়িতে আয়েশ করে বসে ছবিটা তুলেছেন। ক্যাপশন দিয়েছেন, ‘দেবী দশভুজা’। এতে তাঁর সাংবাদিক স্ত্রী আহ্লাদিত হয়েছেন বলে মনে হয়নি। ওসব দশভুজা-টুজা আখ্যা দিয়ে শ্রমসাধ্য সব কাজ করিয়ে নিয়ে মহান সাজার চেষ্টা না করাই ভালো। কারণ, বাড়ি ফিরে ‘আমার বউ কোনো কাজ করে না’ এ কথা বলে অনেক পুরুষই মাথার ওপর ছড়ি ঘোরান।

কোটি মানুষের সামনে সাকিবের মতো বউয়ের প্রশংসা যদি না-ও করতে পারেন ক্ষতি নেই, কিন্তু খিচুড়ির সঙ্গে কালা ভুনা রান্না করে টেবিলে পরিবেশন করলেই তাঁরা বর্তে যাবেন।

উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।