সাধারণ মানুষ যা শিখিয়েগেল

স্বজনের খোঁজ অথবা লাশ পাওয়ার আশা এখনো ছাড়েননি অনেকে
স্বজনের খোঁজ অথবা লাশ পাওয়ার আশা এখনো ছাড়েননি অনেকে

সাভার ট্র্যাজেডিতে আমরা কিছুটা রাজনীতির গন্ধ পেয়েছিলাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছিলেন, বিএনপি-জামায়াতের লোকজন খাম্বা ধরে ভবনটিকে নাড়া দিয়েছিল বলে সেটি ভেঙে পড়েছে। সেটি মানুষের মধ্যে যতটুকু হাসির খোরাক জুগিয়েছে, মানুষ আবার ধিক্কারও জানিয়েছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও রাজনীতি থেমে ছিল না। তারা বলেছিল, সরকার অনেক লাশ গুম করে ফেলছে। লাশ সরানোর ব্যাপারটি সাভারের একজন উদ্ধারকর্মীর কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল। তিনি জানালেন, লাশ সরানোর প্রশ্ন আসবে কেন? হাজার হাজার মানুষের মাঝখান দিয়ে হাজার হাজার লাশ সরানোর সুযোগ কোথায়? যারা এসব প্রশ্ন তোলে তারা কি একবারও ভেবেছে, যাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে উদ্ধারকর্ম চালিয়েছেন, তাঁদের প্রতি কী রকম অসম্মান করা হয়?

উদ্ধারকর্ম শেষ হয়েছে কদিন হয়ে গেল। সেখানে এখন স্মৃতি ছাড়া কিছু নেই। বাতাসে একধরনের গন্ধ। কেউ কেউ মন্তব্য করছে, এসব পচা লাশের গন্ধ। ওই জায়গায় এখনো কৌতূহলী ও  স্বজনহারা মানুষের আনাগোনা। যারা আহত হয়ে হাসপাতালে শুয়ে আছে, তাদের সবাই দেখতে যাচ্ছে। কিন্তু যারা নিখোঁজ, তাদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কেউ কোনো সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেনি। ময়মনসিংহের ১৪ বছরের মেয়ে রেখা। তার লাশ চিহ্নিত করা যায়নি। রানা প্লাজার পাশে উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন মা মর্জিনা বেগম। পাশে দাঁড়িয়ে বাবা। তাঁরা লাশ পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, মেয়ে যদি পঙ্গু হয়ে বেঁচেও থাকত, একধরনের সান্ত্বনা তাঁরা পেতেন। লাশ পেলে কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকতেন। বেঁচে থাকলে কিছু সাহায্য-সহযোগিতা তাঁরা পেতেন। এখন এ কূল-ও কূল দুই কূলই গেছে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার রাহাখরচও হাতে নেই। এ রকম আরও অনেকে আছেন।

সাভারের এনাম হাসপাতালে এখনো অনেক আহত রোগী বিছানায় শুয়ে। তাদের অনেকের হাত-পা নেই। তারা যেন বেঁচে থেকেও মরা। তাদের অনেকে সাহায্য-সহযোগিতা করে যাচ্ছে বটে, কিন্তু তা নিয়ে তারা আহ্লাদিত নয়। টাকাটা তাদের খুবই দরকার। কিন্তু পোড়া শরীরের ভার সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, এই ভাবনাই তাদের হতাশাচ্ছন্ন করে তুলেছে। ঘটনাচক্রে মনে হয়েছে সাহায্য-সহযোগিতার পুরোটা তারা পাচ্ছে না। তাদের চারপাশে ঘিরে থাকা আত্মীয়স্বজন যে টাকাপয়সা সরিয়ে নিচ্ছে না, তা বলা মুশকিল। অনেক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা কত টাকা সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে কেউ জানে না। জানে তাদের আত্মীয়স্বজন। কিন্তু সেই আত্মীয়স্বজন টাকার সঠিক তথ্যটা কাউকে দিচ্ছে না।

এনাম হাসপাতালের প্রধান এনাম সাহেব মনে করেন, যে হারে সাহায্য-সহযোগিতা এসেছে তাতে একেকজনের ভাগে ১২ থেকে ১৬ লাখ টাকা পড়ার কথা। যেসব নারী হাত-পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, সেই সুবাদে তারা কিছু টাকা পেয়েছে বটে, কিন্তু ওই টাকা স্বামী যথেচ্ছভাবে খরচ করবে, তার নিশ্চয়তা কী? একসময় যখন টাকা ফুরাবে, তখন স্বামী পরিত্যক্ত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। স্ত্রীর সাহায্যের টাকা দিয়ে কোনো কোনো স্বামী গ্রামে গিয়ে জায়গা কিনছে। এ জায়গা নিশ্চয় স্ত্রীর নামে কিনছে না। সুতরাং যেসব টাকা মানুষজন সাহায্য হিসেবে দিচ্ছে, তা সঠিক খাতে ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা দরকার। সবকিছু দেশের সমাজের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে করা উচিত। বিক্ষিপ্তভাবে যেসব সাহায্য-সহযোগিতা এসেছে, তা একটা জায়গায় আসা উচিত ছিল। যেসব টাকা তাদের হাতে পৌঁছে গেছে, ওই টাকা দিয়ে সব আহত মানুষকে সুন্দরভাবে পুনর্বাসন করা যেত। যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছে, তাদের অবশ্য অবশ্যই পুনর্বাসিত করতে হবে।

নিহত ব্যক্তিদের সুষ্ঠু তালিকা প্রণয়ন করা দরকার। এটা খুব একটা সহজ কাজ নয়। যাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি মারা গেছে, তাদের ব্যাপারটি বিশেষভাবে নজরে আনতে হবে। যাদের মা-বাবা উভয়েই মারা গেছে, ওই পরিবারের সন্তানদের কী করা যায়, তা ধর্তব্যের মধ্যে আনা উচিত। আপামর জনগোষ্ঠী যেভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, তাতে অসম্ভব কাজটিও সম্ভব হয়ে উঠতে বাধ্য।

সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে অনেক মানুষ প্রাণে বেঁচে গেছে। খুব আফসোস হয়, অনেক নামীদামি হাসপাতালের সম্পৃক্ততা আমরা দেখতে পাইনি। সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। অবাক হয়ে ভাবতে হয় অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের কথা। লাশ আর অসহায় মানুষের নিত্য যাতায়াত ছিল এ বিদ্যালয়ের মাঠে। শিক্ষার্থীরা ঘটনার শেষ না দেখা পর্যন্ত ক্লাস করতে পারেনি। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অসহায় মানুষের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সাভারের সাধারণ মানুষের উদারতার কথা ভাবলে ভরসা জাগে। তারা তো উদ্ধারকাজে নিয়োজিত ছিলই, প্রতিদিন নিজেদের বাড়ি থেকে রান্না করে এনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলিও করেছে। তাদের মানবতা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।

অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হারুনুর রশীদের অমানুষিক পরিশ্রম না দেখলে বোঝা যাবে না। এখনো তাঁর চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বেদনায় তাঁর বুকটা ভারী হয়ে আছে, তার পরও একটা আত্মতৃপ্তি তাঁর রয়েছে এ ধরনের একটা কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে। বিদ্যালয়ের বারান্দায় শত শত লাশ রাখা হতো, মাঠে রাখলে তাড়াতাড়ি পচন ধরার ভয়ে। লাশ আনা-নেওয়া শেষ হলে হারুনুর রশীদ পুরো বারান্দা কালো রং দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। এ সম্মানকে কীভাবে আমরা খাটো করে দেখব? মানবতার জয় হোক।

l নূরুল আনোয়ার: লেখক ওউন্নয়নকর্মী।