সিআরবির জন্য করজোড়ে মিনতি

চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকার শিরীষতলা।
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, বিশেষত পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা নিয়ে গঠিত ভূমি এবং নদী-সমুদ্র-বনানীবেষ্টিত নৈসর্গিক রূপ যুগে যুগে পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে। চতুর্দশ শতকের মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা বিশাল সমুদ্রের তীরবর্তী এই বন্দরনগরীর রূপবৈচিত্র্যে হর্ষ প্রকাশ করেছিলেন। তারও ২০০ বছর আগে আরব ভূগোলবিদ আল-ইদ্রিসি একে বিশাল বাণিজ্যিক নগরী আখ্যায়িত করে প্রশংসায় ভাসিয়েছেন।

১৭৮৬ সালে চট্টগ্রাম এসেছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোনস (১৭৪৬-১৭৯৪)। তাঁর মনে হয়েছে, প্রকৃতিপ্রেমিকদের জন্য চট্টগ্রাম হলো এক মহৎ অঞ্চল। বন্ধুকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আমি স্বাস্থ্যের উপকারের লক্ষ্যে গ্রীষ্মের সময় চট্টগ্রামে সামুদ্রিক বাতাস আর সবুজ পাহাড়ি দৃশ্য উপভোগের জন্য এসেছিলাম।’ আর ক্যাপ্টেন পগসন ১৮৩১ সালে তাঁর চট্টগ্রাম সফর নিয়ে রচিত বইয়ে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রাম এক রোমান্টিক সুন্দর শহর; সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় শত ফুট উঁচু পাহাড়ের সারির ওপর বাড়ি; টিলা ও উপত্যকাগুলো আম, সুপারি, নাগেশ্বরের মতো গাছে ভর্তি; এখানে বাতাস শীতল, বিশুদ্ধ এবং প্রশান্ত; সমুদ্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এর আবহ।’

আমাদের শৈশবে পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার, আন্দরকিল্লাসহ, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ এবং স্ট্র্যান্ড রোড-মাঝিরঘাটের মতো বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলো বাদ দিলে বাকি শহরটাই ছিল জন বিমসের বর্ণনার কাছাকাছিই। এটি ছিল শান্ত, নির্জন প্রকৃতিময় এক জনপদ। আমাদের বাসার সামনে ছিল দিগন্তজোড়া মাঠ। তাতে টিলাও ছিল, গভীর খাদ, গিরিপথ, আবার ছিল প্রশস্ত খোলা জায়গা। পরে টিলা ছেঁটে স্টেডিয়াম হলো, বাইরে আউটার স্টেডিয়ামে ছিল তিনটি মাঠ। ওদিকে উত্তরে সার্কিট হাউস ব্রিটিশ-বর্মিজ স্থাপত্যের অপূর্ব স্থাপনা—সঙ্গে উপযুক্ত সবুজ চত্বর, শালবন। এখন ভবনে জিয়া জাদুঘর আর তাকে আড়াল করে এর আবশ্যিক নান্দনিক অঙ্গ সবুজ চত্বর দখল করে তৈরি হয়েছে শিশুপার্ক। মুশকিল হলো, নামে শিশুপার্ক হলেও এটি নিজেই অসুন্দর এবং মূল ভবনকে আড়াল করেছে এবং তার সৌন্দর্য হরণ করেছে। ভাবা যায়, শহরেই তখন দুই পাহাড়ের মাঝের জমিতে রীতিমতো গলফ কোর্ট ছিল!

১৯৬১ সালে আইয়ুব খানের সময় যখন চট্টগ্রাম নগরী নিয়ে প্রথম মাস্টারপ্ল্যান তৈরি হয়, তখনো প্রচুর পার্ক ও উন্মুক্ত প্রাকৃতিক স্থান রাখা হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকেই ‘উন্নয়নের’ যে ধাক্কা শুরু হলো, তাতে এ পরিকল্পনার তোয়াক্কা কেউ করেনি; স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্যের বিবেচনা রাখেনি। এমনকি জনস্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য, নগরী ও নগরজীবনের সুস্থতার কথাও ভাবেনি। ষাটের দশকেও কেউ ভাবতে পেরেছে বর্ষায় চট্টগ্রাম শহরে পানির ঢল বইবে?

আমাদের বাসা ছিল সামনের রাস্তা থেকে অন্তত দশ ফুট নিচে। চট্টগ্রামের বিখ্যাত ধারাবর্ষণের সময়—যা হয়তো চলত টানা সাত দিন ধরে—কই, আমাদের উঠোনে এক ইঞ্চি পানিও তো জমত না! জমবে কীভাবে, পেছনের জায়গা ছিল আরও নিচু, যা পানি বয়ে নিত কাছের খালে। স্কুলফিরতি বর্ষার দিনে কত জলকল্লোলের ধারা দেখতাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে কালভার্টের রেলিংয়ে ঝুঁকে। আসকার দিঘি তখন টলটলে জলে ভরপুর এক সত্যিকারের রূপকথার দিঘি! পাড় দখল হতে হতে লোকচক্ষুর আড়ালে এখন এঁদো পুকুর।

কেন আফসোস ঝরছে লেখায়? একি কেবল শৈশব স্মৃতি নিয়ে অযথা কাতরতার প্রকাশ? না, আফসোস এই জন্য যে এসব রেখেও—এই পাহাড়, ঝরনা, খাল, বনানীর অধিকাংশ—এ নগরীতে পঞ্চাশ-ষাট লাখ মানুষের বসতি সংকুলান করা যেত। তার আনুষঙ্গিক স্কুল, হাসপাতাল, বিপণি, অফিস-আদালত, সবই সম্ভব ছিল। কেবল প্রয়োজন ছিল এই মাটির, যা আদতে দান, তার যে প্রাচুর্য ও সৌন্দর্য তার প্রতি একটু সংবেদনশীলতা, একটু ভালোবাসা, যা তৈরি করত অঙ্গীকার, খুলে দিত উন্নয়নের দূরদৃষ্টি। রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামতের কাজ করতে হয় জরুরি ভিত্তিতে, অনেক সময় তাড়াহুড়া করে কাজ সারতে হয়। কিন্তু সেই তুলনায় নতুন পরিকল্পনা এবং সে অনুযায়ী নির্মাণকাজ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার জন্য অনেক ভাবনা বহুতর বিবেচনার জায়গা থাকা এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো সময় দেওয়া সময় নেওয়া দরকার। সময় সবটা বোঝার জন্য, সুষ্ঠু পরিকল্পনার জন্য।

পরিকল্পনাবিদ ও নীতিনির্ধারকেরা, করজোড়ে মিনতি জানাই, দেশের প্রকৃতি, বিশেষত মাটির প্রকৃতিকে আরও একটু বুঝে নিন। ইতিহাস বলছে, এর ভূমি মূলত নদীর সৃষ্টি, তাই নদীই এর প্রাণ। প্রাণ নিয়ে যেকোনো নিরীক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ, বিপজ্জনক। তার আগে অনেক প্রস্তুতি প্রয়োজন। এখানে ঝুঁকি নিয়ে ব্রিংকম্যানশিপের সুযোগ নেই। অথচ আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে নদীরও মৃত্যু দেখতে হচ্ছে—একি উন্নয়নের বলি!

শেষ কথা সিআরবি, টাইগারপাস। একটু তুলনা দিয়ে বলি চট্টগ্রামে ঢাকার মতো রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চন্দ্রিমা উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বলধা গার্ডেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা সংসদ এলাকার মতো খোলা সবুজ জায়গা একটিও নেই। যেতে যেতে হারাধনের শেষ সম্বল এই সিআরবি-টাইগারপাস এলাকা। টাইগারপাস আলাদা নয়, সিআরবিরই অঙ্গ। শহরে জনবসতি আরও বাড়ছে—এটুকু ফুসফুস অপর্যাপ্ত হলেও অন্তত এটুকুও যেন কেড়ে নেওয়া না হয়।

বলা দরকার, হাসপাতাল জরুরিভাবে প্রয়োজন, বিশেষায়িত হাসপাতাল হোক ডায়াবেটিক হাসপাতালের মতো সমিতির পরিচালনায় সাধারণের কল্যাণে নিবেদিত। এ রকম কিডনি, হার্ট, গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল হোক না আরও। জায়গার অভাব হবে না। আন্দোলনে নেমে আমরা দেখছি, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সবাই এতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীসহ ঢাকার নেতারাও এ বিষয় নিশ্চয়ই বিবেচনায় রাখছেন।

সিআরবি চট্টগ্রামের ফুসফুস। আর টাইগারপাসের সৌন্দর্যের গুরুত্ব তার মহিমায়, যা ওপর থেকে বোঝা যায় না, নিচে দাঁড়িয়ে বুঝতে হয়। এটুকু জায়গায় ফ্লাইওভার বাদ দিয়ে নিচের রাস্তা আরও প্রশস্ত করা এবং জরাজীর্ণ দেওয়ানহাট পদচারী–সেতুর জায়গায় নতুন প্রশস্ত পদচারী–সেতু করে একটু এগিয়ে শেখ মুজিব সড়কের ফায়ার ব্রিগেডের সামনে থেকেই আবার ফ্লাইওভার শুরু হতে পারে। দোহাই, ফুসফুসে কেউ হাত দেবেন না। এটি রেল কর্তৃপক্ষের ফুসফুস নয়; চট্টগ্রামের, সমগ্র চট্টগ্রামের নাগরিকদের ফুসফুস। এটুকু বিবেচনা খুব বেশি চাওয়া নয় নিশ্চয়।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক