সিরিয়া যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরব

দুই মিত্র আসাদ ও পুতিন
দুই মিত্র আসাদ ও পুতিন

বর্তমান সিরিয়া সংকটটি হচ্ছে দুনিয়ার গণতন্ত্রমনা মুক্তিকামী মানুষের অসহায়ত্বের প্রতিচ্ছবি। স্বৈরাচার আসাদকে উৎখাত করতে যেসব শক্তি উঠেপড়ে লেগেছে, তারা সেখানে একটি নতজানু সরকার প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত, যার মাধ্যমে সিরীয় জনগণের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলির পথ উন্মুক্ত হবে। সিরিয়া ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতির পাশাপাশি আঞ্চলিক রাজনীতির অন্যতম খেলোয়াড় সৌদি আরবের নিজস্ব স্বার্থও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার পাশাপাশি সৌদি আরবের ভূমিকাও গুরুত্ব দিয়ে দেখা জরুরি। মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত অবস্থান ও তেলসম্পদের ওপর দখল বিস্তারের লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে তার আধিপত্য বজায় রাখতে চায়। আরও কারণ হলো, তার মিত্রদেশ ইসরায়েলের নিরাপত্তা বিধান করা। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সরকারের পক্ষেই ইসরায়েলের ওপর চাপ প্রয়োগ করা কঠিন, কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রায় সব স্তরেই ইসরায়েলের সমর্থকদের আধিপত্য। শুধু তা-ই নয়, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ওয়াশিংটন পোস্ট-এর মতো প্রভাবশালী পত্রিকা ছাড়াও বিশ্বের ৯৬ শতাংশ মিডিয়া যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা ধর্মীয় ও অন্যান্য কারণে ইসরায়েলের বর্ণবাদী নীতির সমর্থক। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বিস্তার, তেলসম্পদের দীর্ঘমেয়াদি দখল ও ইসরায়েলের স্বার্থরক্ষা সিরিয়া যুদ্ধের মাধ্যমে কতটুকু সম্ভব? তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে কি কোনো মূল্য দিতে হবে না এই যুদ্ধে? লাভ-ক্ষতি ও আঞ্চলিক রাজনীতির চিত্র ওবামা আশ্বস্ত করতে চাইছেন, সিরিয়ায় ‘সীমিত সামরিক হামলা’ করা হবে। কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব, যদি সিরিয়া, হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইরান চুপচাপ হামলা হজম করে যায়; যার সম্ভাবনা খুবই কম। সিরিয়ার বিদ্রোহীদের আল-কায়েদার সঙ্গে সখ্য রয়েছে। যদিও সেটি ‘আমার শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু’ নীতিতে। কিন্তু বিদ্রোহীরা ক্ষমতায় এলে আল-কায়েদা যে সুবিধা পাবে না, তা বলা যায় না। মূল বিষয়টি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত পররাষ্ট্রনীতি। তারা আল-কায়েদার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামে ২০০১ সাল থেকে লড়াই করে আসছে। কিন্তু আল-কায়েদা ও তার সহযোগী আল-নুসরা ফ্রন্ট যে আসাদের পতনে আরও শক্তিশালী হবে, সে বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র এড়িয়ে যাচ্ছে। এই অস্থিতিশীল অবস্থায় শিয়া অনুসারী হিজবুল্লাহ ও সুন্নি অনুসারী আল-কায়েদার সমর্থিত আল-নুসরা ফ্রন্টের মধ্যে সংঘাত বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা তো থেকেই যায়, যা এই অঞ্চলে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দেবে। এই যুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই হিজবুল্লাহর সম্পৃক্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে ভৌগোলিকভাবে সংযুক্ত থাকায় হিজবুল্লাহর বাড়তি সুবিধাও রয়েছে সিরিয়ার তুলনায়। হামাসও ২০০৯ সালের যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং অবশ্যম্ভাবীভাবেই তারা তাদের রকেট ও বিমানবিধ্বংসী সক্ষমতা বাড়িয়েছে। সুতরাং, যুদ্ধ বাধলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইসরায়েলকেও চরম মূল্য দিতে হবে।

সম্প্রতি ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি পরমাণুর বিষয়ে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন। এই হামলা সেই প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করবে। বস্তুত, ইরান তার অস্তিত্ব রক্ষায় পরমাণু অস্ত্রের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে যাবে। তার দেশের অভ্যন্তরে যুক্তরাষ্ট্রবিদ্বেষী মনোভাব আরও দৃঢ় করতে সক্ষম হবে, যা তার নৈতিক মনোবল বাড়াবে। এই অঞ্চলে পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বাড়লে হুমকিতে পড়বে ইসরায়েল। পারমাণবিক শক্তিধর ইরান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যদি আগেভাগেই ইসরায়েলকে হামলা করে বসে, তাহলে ভৌগোলিক আয়তনে ছোট হওয়ায় ইসরায়েল ইরানের চেয়ে বেশি অসুবিধায় পড়বে। এ ছাড়া সৌদি আরবসহ তুরস্ক, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকেও পারমাণবিক শক্তিধর হতে প্রলুব্ধ করবে, যা এই অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তুলবে। স্বাভাবিকভাবেই এতে করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের আধিপত্য হ্রাস পাবে। এই সবকিছু বিবেচনায় দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের লোকসানের পাল্লা বেশ ভারী বলেই মনে হয়। সবশেষে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে যে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অটোভন বিসমার্ক মৃত্যুভয়ে আত্মহত্যা করার শামিল বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সৌদি আরবের স্বার্থ সিরিয়ায় হামলার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সৌদি আরব। বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাতের জন্য সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা ছাড়াও সম্প্রতি সে আরব লিগের সম্মেলনে আরব দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সিরিয়া মিশনে সমর্থন দিতে অনুরোধ জানায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গত ৩ আগস্ট প্রতিনিধি পরিষদের এক শুনানিতে বলেন, আরব দেশগুলো সিরিয়া যুদ্ধের সমস্ত ব্যয়ভার বহনের প্রস্তাব দিয়েছে। সহজেই অনুমেয় যে সৌদি আরবসহ আসাদের পতনের ফলে যেসব দেশের স্বার্থ জড়িত, তারাই এই প্রস্তাব করে থাকবে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে তার নিজের প্রভাব অটুট রাখা, ইরানের প্রভাব ঠেকানো ও সিরিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব সৌদি আরবের এসব কার্যক্রমের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে।

বিভিন্নভাবে সংকটকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা সফলতার মুখ না দেখায় শেষ আশ্রয় হিসেবে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তিকে ব্যবহার করতে চাচ্ছে। সৌদি আরব ছাড়াও কাতার এই পর্যন্ত তিন বিলিয়ন ডলার দিয়েছে সিরিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে। কাতার পারস্য উপসাগর থেকে সিরিয়া দিয়ে তুরস্কে প্রাকৃতিক গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে যেতে চায়, যা আসাদ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সমর্থিত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো রাশিয়ার ওপর থেকে ইউরোপের প্রাকৃতিক গ্যাসনির্ভরতা কমানো। আরেক পশ্চিমা মিত্র তুরস্কও এই প্রকল্প থেকে লাভবান হবে। সৌদি আরব চায় সিরিয়ায় একটি পুতুল সরকার বসাতে, যার মাধ্যমে সে এই অঞ্চলের জ্বালানি শক্তির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আসাদ চান রুশ সমর্থনে এই পাইপলাইন আটকে রাশিয়ার কোম্পানি গ্যাজপ্রমকে সুবিধা দেওয়া। সাংবাদিক ডেইল গাভলাস দুই যুগ ধরে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন, ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওতে (এনপিআর) কাজ করেছেন এবং বিবিসির জন্য অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, সিরিয়ার বিদ্রোহীরা তাঁর কাছে স্বীকার করেছে যে, তারা রাসায়নিক অস্ত্রের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তাদের সৌদি আরব থেকে যে রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করা হয়েছিল, তা অসাবধানতার ফলে এই দুর্ঘটনা ঘটে প্রাণহানি ঘটেছে। ভয়েস অব রাশিয়াও এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গাভলাস যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফকে উদ্ধৃত করে বলেন, সৌদির যুবরাজ বান্দার বিন সুলতান পুতিনকে এই বলে হুমকি দেন যে যদি রাশিয়া সিরিয়া ইস্যুতে তার অবস্থান না বদলায়, তাহলে আগামী বছর রাশিয়ায় অনুষ্ঠেয় উইন্টার  লিম্পিকসে চেচেন বিদ্রোহীদের মাধ্যমে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হবে। এ ছাড়া পুতিনকে যুবরাজ প্রতিশ্রুতি দেন যে আসাদের পতন ঘটলে সিরিয়ায় রাশিয়ার নৌঘাঁটি তারা রক্ষা করবে এবং আলোচনাও চালিয়ে যাওয়া হবে। শেষ কথা আসলে সিরিয়া সংকট হলো প্রাকৃতিক সম্পদ, ধর্ম ও অর্থসম্পর্কিত একটি কৌশলগত ভূরাজনৈতিক সংকট এবং রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি এই ভূরাজনৈতিক স্বার্থের তুলনায় খুবই নগণ্য। তা না হলে দুই বছর ধরেই আসাদ বাহিনী যুদ্ধ করছে এবং ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসার পর আসাদ তাঁর শাসনব্যবস্থার উদারীকরণের লক্ষণ দেখাননি। পুরো ব্যাপারটি দেখলে মনে হয়, রাসায়নিক অস্ত্র ছাড়া মানুষ হত্যা করা হলে তা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার ‘স্বর্গীয় দূত’ পশ্চিমা দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ হবে না। আসল কথা হলো, সিরিয়ায় পুতুল সরকার বসানোর জন্য একটি অজুহাতের দরকার ছিল এবং রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ‘জনশ্রুতি’ যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশের স্বার্থ রয়েছে, তাদের সামনে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে।

খলিলউল্লাহ্: সহকারী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।
[email protected]