সৃজনশীল শিক্ষা নিয়ে ভজকট

প্রায় এক দশক ধরে দেশে সৃজনশীল শিক্ষা নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষা কি এগোচ্ছে?
ছবি: প্রথম আলো

প্রায় এক দশক ধরে দেশে সৃজনশীল শিক্ষা নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে। আলোচিত হচ্ছে ‘শিশুকেন্দ্রিক’ আর ‘সৃজনশীল’ শিক্ষার কথা। হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার মান ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ সবার।

‘শিশুকেন্দ্রিক’ ও ‘সৃজনশীল শিক্ষা’ কি একেবারে হাল আমলের কোনো পদ্ধতি? এখানে আমরা দেখার চেষ্টা করব, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসে বিকশিত অবরোহী ও আরোহী শিক্ষার সঙ্গে ‘শিশুকেন্দ্রিক’ আর ‘সৃজনশীল’ শিক্ষার মিল-অমিল; আর সেই সঙ্গে বাংলাদেশে তার প্রয়োগ ও সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান।

প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল গুরু আশ্রমকে কেন্দ্র করে। সেখানে গুরুর আদেশ পালনই ছিল শেষ কথা। গুরুর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যই ভারতীয় শিক্ষার সৌন্দর্য। গ্রিসে কিন্তু অন্য রকম ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। প্রাচীন গ্রিসের যে শিক্ষাব্যবস্থা আজও পৃথিবীর মনোযোগ কাড়ে, তা হলো সক্রেটিসের ‘শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতি’। তিনি শিষ্যদের নিয়ে বসতেন রাস্তার মোড়ে। সেখানে চলত সওয়াল-জবাব। চলত সত্য জানার চেষ্টা। শিষ্যরাই তার জবাব খুঁজত। গুরু সক্রেটিস সওয়াল করে করে সত্য বের করতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতেন। দর্শনশাস্ত্রে তার নাম অবরোহী (ডাইডেক্টিভ) পদ্ধতি।

সক্রেটিসের সেরা শিষ্য প্লেটো। প্লেটোর ছিল বিশাল শিক্ষা পরিকল্পনা। সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েও সেসব পরিকল্পনা এখনো মানুষকে সমান ভাবায়। প্লেটোর সেরা শিষ্য অ্যারিস্টটল। তিনি যুগান্তকারী মহাপণ্ডিত। বলা হয়, এত বড় পণ্ডিত আর বিজ্ঞানী পৃথিবীতে আর কেউ আসেননি। মহাবীর আলেকজান্ডার ছিলেন তাঁর স্কুল লাইসিয়ামের ছাত্রদের একজন। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা বিপুল। জ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই, যা নিয়ে তাঁর রচনায় কিছু না কিছু ইঙ্গিত নেই। এমনকি আধুনিক যুগে আবিষ্কৃত অনেক বিজ্ঞানের উৎস খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর রচনায়। শিক্ষাদানে তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের একেবারে বিপরীত ধারা আবিষ্কার ও অনুসরণ করেন। ক্লাসে তিনি অসাধারণ বক্তৃতা করতেন, ছাত্ররা তার নোট রাখত। তাঁর জ্ঞানের বিপুল ভান্ডার তিনি উজাড় করে দিতেন ছাত্রদের পড়ানোর সময়। জ্ঞানদানের সে প্রবল বন্যায় ছাত্ররা ভেসে যেত। যে বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করতেন, তার আদ্যোপান্ত সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে উঠত। আলোচনা তিনি সমৃদ্ধ করতেন সে কালের সেরা পণ্ডিতদের জ্ঞানের নির্যাসে। কিন্তু তাঁর পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা সক্রিয় হতে পারত না। তবু প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চায় তা ছিল প্রশ্নহীন।

শিক্ষাদর্শনে এর নাম আরোহী (ইনডাক্টিভ) পদ্ধতি। অ্যারিস্টটলের পাণ্ডিত্য নিয়ে যেমন কেউ প্রশ্ন তোলে না, তেমনি শিষ্যদের শিক্ষাদানে তাঁর আন্তরিকতা নিয়েও কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। তিনি ছাত্রদের ভালোবাসতেন। নিজে রাতদিন পরিশ্রম করতেন আর ছাত্রদের শেখাতেন সর্বশক্তি উজাড় করে।

এবার আমরা শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার মর্মবস্তু বোঝার চেষ্টা করব। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় মেনে নেওয়া যে শিশুর মন একেবারে ‘সাদা কাগজ নয়’। তার মনে হাজার প্রশ্ন উঁকি মারে আর খেলা করে স্বপ্ন। শিশুর স্বাভাবিক আচরণগুলো হলো এসবেরই স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। শিক্ষার ব্যুৎপত্তি খুঁজতে ভারতীয় সংজ্ঞা যতই সংস্কৃত ‘শাস’ ধাতুর শরণ নিয়ে ’শাসন’ করার তরিকা খুঁজুক না কেন, গ্রিক ‘এডুকেয়ার’ বা ‘বের করে আনা’র তত্ত্বই যথার্থ মনে হয়। শিশুর মধ্যে যে সৃজনী ক্ষমতা আছে, তা বের করে আনাই শিক্ষকের আসল কাজ। প্রাচীন গ্রিসে গুরুকে মান্য করা হতো ‘পেডাগগ’ বা শিশুদের নেতা হিসেবে। আর নেতা হতে গেলে সবার আগে হতে হয় শিশুর বিশ্বস্ত বন্ধু।

সক্রেটিস শিষ্যদের প্রশ্ন করতেন। শিষ্যরা জবাব খুঁজত। এ জবাব খোঁজার জন্য শিশুদের ভাবতে হয়। আধুনিক পরিভাষায় তাকে বলা হয় ‘মাথা ঘামানো’ বা ‘ব্রেন স্টর্মিং’। শেখার জন্য এটাই আসল কৌশল। মাথা ঘামাবে শিশু, যাকে শেখানো হবে। প্রশ্ন করতেও গুরুকে মাথা ঘামাতে হয়। অর্বাচীন প্রশ্ন অর্বাচীন জবাবের দরজা খুলে দিতে পারে। তাই শিক্ষককে শিখতে হয় কোন প্রশ্ন কীভাবে করতে হয়। শিক্ষক সেটা অনুসরণ করেন কি না, সেটা যাচাই করা যায় ক্লাসে শিক্ষকের ‘সক্রিয়তার সময়’ বিচার করলে। সওয়াল-জবাব শিখন-শিক্ষণের অন্যতম জরুরি শর্ত। সওয়াল-জবাবের ‘সময় ভাগ’টাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্নকর্তা আর উত্তরদাতার ‘সময়’ সমান হতে পারে না। একেবারে বাঁধাধরা সময় ভাগ করা সমীচীন না–ও হতে পারে। তবে মোটামুটি শিক্ষকের চেয়ে সক্রিয় শিক্ষার্থীর সময় দ্বিগুণ হওয়া উচিত।

ক্লাসে শিক্ষক পড়াবেন, এ কথার অর্থ হলো শিক্ষক সুচিন্তিত প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তিকে উসকে দেবেন। শিক্ষার্থী চেষ্টা করবে তার যথার্থ জবাব খুঁজে বের করতে। প্রশ্ন যত বেশি সৃজনশীল হবে, শিশুর জবাবও তত বেশি সৃজনশীল হবে। এটাই হলো সৃজনশীল শিক্ষার মূল তত্ত্ব। সক্রেটিসের অবরোহী পদ্ধতি তার ভিত্তি। গত শতকে বেঞ্জামিন ব্লুম নামের এক মার্কিন শিক্ষা মনোবিজ্ঞানী তাঁর সহকারীদের নিয়ে এই বহু পুরোনো শিক্ষাতত্ত্ব নতুন করে চর্চা শুরু করেন। তার ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় ব্লুম টেক্সোনমি। সেখানেই তাঁরা সর্বোচ্চ ধাপে জ্ঞান নির্মাণ বা সৃজনের কথা বলেন। সে তত্ত্ব ব্যাপকভাবে পরিমার্জিত হয়ে প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। ব্লুম ও তাঁর শিষ্যরা সৃজনশীল শিক্ষকদের জন্য ছয়টি ধাপে মোট ২৭৩ ক্রিয়াপদের এক তালিকা নির্দিষ্ট করে দেন।

বিদেশি ঋণের টাকায় ২০০৭ সালে এই ব্লুম টেক্সোনমির একটি অপকৃষ্ট বয়ান বাংলাদেশে প্রথমে ‘কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন’ নামে চালুর চেষ্টা হলে প্রবল বাধার মুখে পড়ে। পরে ২০০৯ সালে তা বাঁকা পথে চালু হয় মনোহরণ ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ নামে।

কিন্তু এক দশকেও বাংলাদেশের শিক্ষকেরা সৃজনশীল প্রশ্ন করা আয়ত্ত করতে পারেননি। অবশ্য প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সুবিধাভোগীরা চেঁচাচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা নাকি এরই মধ্যে দারুণ সৃজনশীল হয়ে উঠেছে! আমাদের কাছে এসবই কুহেলিকা মনে হয়। তবে খোদ শিক্ষা দপ্তর যে জরিপ চালিয়েছে, তার ফলাফল মোটেই কর্তাদের দাবি সঠিক বলে প্রমাণ করে না। জরিপে দেখা যায়, মোটা দাগে শিশুর অর্জিত জ্ঞান ২৫ শতাংশের নিচে!

এ ব্যর্থতা কেন? সেটাই আসল প্রশ্ন। সে জবাব খুঁজে বের করতে আমরা এখন দুটো বিষয়ে নজর দিতে পারি। পড়ানোর পদ্ধতি আর শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ‘টকিং টাইম’-এর অনুপাত। এ জন্য আমরা দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরখ করে দেখতে পারি। বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে চলছে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম। সংসদ টিভিতে (দূরশিক্ষণের) নিয়মিত ক্লাস চলছে সরকারের তত্ত্বাবধানে। আমাদের সন্তানদের কীভাবে পড়ানো হচ্ছে, তার সেরা নমুনা দেখার সুযোগ আমাদের হাতের মুঠোয়। টিভির বদৌলতেই আমরা এখন সহজে ঢুকে পড়তে পারছি ক্লাসরুমে। যে কৌশলে দেশের ‘সেরা শিক্ষকেরা’ প্রতিদিন পড়াচ্ছেন, তাতে অভিভাবকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কয়েক দশক ধরে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম চালানোর পরও তাতে কোনো উন্নতির আভাসমাত্র নেই। দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকেরা নিজেদের অ্যারিস্টটলের মতোই মহাপণ্ডিত জ্ঞান করেন। ক্লাসরুম তাঁদের পাণ্ডিত্য দেখানোর পবিত্র স্থান। তাঁদের পাঠদানের পদ্ধতি মূল্যায়ন করলে শিক্ষার নিকষ কালো আঁধার আমাদের সামনে হাজির হয়। প্রাণহীন, একঘেয়ে, সেকেলে পদ্ধতির এই শিক্ষাদান আর যা–ই হোক আমাদের সন্তানদের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযুক্ত করে গড়ে তুলবে না। শিক্ষাবিজ্ঞানে ‘সেরা’ শিক্ষকদের সীমাহীন অজ্ঞতা আর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে নিদারুণ অদক্ষতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তাঁরা ভুলে যাচ্ছেন যে আমাদের দরকার একেকজন সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল নয়।

আমিরুল আলম খান, যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।

[email protected]