‘সেফ জোন’ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরানো যাবে না

ফাইল ছবি


প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য আঞ্চলিক একটি শক্তির মধ্যস্থতায় ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো। এর পর প্রায় ৩ বছর পার হলেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। বাংলাদেশ সরকার কয়েকবার পদক্ষেপ নিল, মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিবের আশ্বাসও এল; কিন্তু রোহিঙ্গারা যেতে রাজি হলো না। ওই চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে অবশ্যই কিছু কারণ রয়েছে। তবে কারণগুলো বিশ্লেষণের আগে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো, এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর অর্থাৎ নিরাপদ ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের জন্য রোহিঙ্গাদের বৈধ দাবিগুলো প্রতিফলিত হয়েছে কি না? এই সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য তাদের দাবিগুলোকে আমলে না নিলে এই চুক্তি কোনো কাজে আসবে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের আশঙ্কা ও বৈধ দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

(১) এই চুক্তি অনুযায়ী মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের আগে তাদের পরিচয়পত্র যাচাই-বাছাই করতে চায়, যা কিনা প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় একটি বড় বাধা। যে জনগোষ্ঠী গণহত্যা, ধর্ষণ, আর জাতি নিধন থেকে নিজেদের জীবনকে বাঁচানোর জন্য ঘরবাড়িসহ সব মূল্যবান জিনিসপত্র ফেলে পালাতে বাধ্য হয়েছে, তাদের কাছে পরিচয়পত্র খোঁজা ধৃষ্টতাই বৈকি। অধিকাংশ রোহিঙ্গার সঙ্গে কোনো পরিচয়পত্র নেই বলে কি তারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়! তাহলে তাদের ভবিষ্যৎ কী?
(২) রোহিঙ্গাদের জন্মগত অধিকার বা নাগরিকত্ব প্রদানের নিশ্চয়তা না থাকা।
(৩) রোহিঙ্গারা মনে করে, তারা কখনোই তাদের ভিটামাটি তথা জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারবে না। তাদের জন্য বন্দী শিবিরের জীবনই বরাদ্দ।
(৪) রোহিঙ্গারা এই সংকটের প্রধান শিকার এবং তারা বিশ্বাস করে যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে একটি ‘সেফ জোন’ প্রতিষ্ঠা ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়।
(৫) রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় স্বাধীনতাসহ সব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা না থাকায় রোহিঙ্গারা ফিরছে না।
রোহিঙ্গাদের এই দাবিগুলোকে অযৌক্তিক মনে করার অবকাশ নেই।

যদিও বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সংকটকে তুলে ধরেছে, কিন্তু চীন ও ভারত বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশ কিংবা মানবতার পক্ষে ছিল না।

২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে রাখাইনে গণহত্যার পর বুশিডং থেকে পালিয়ে আসা ৬৩ বছর বয়স্ক রোহিঙ্গা আলিম উদ্দিন (ক্যাম্প-২৭, জাদিমুরো, টেকনাফ) বলেন যে, তাঁরা এই দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং চুক্তির শর্তাবলি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রোহিঙ্গাদের কোনো প্রতিনিধি কখনোই ছিলেন না। অর্থাৎ যাদের নিয়ে এই সংকট এবং যারা গণহত্যা ও নৃশংসতার শিকার, তাদের কণ্ঠস্বর আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাতেই শোনা যায়নি।

রোহিঙ্গাদের না ফেরার আরেকটি কারণ বলতে গিয়ে আলিম উদ্দিন বলেন, ‘এখানে (বাংলাদেশে) যদি আমাদের মেরেও ফেলে বা আমরা মৃত্যুবরণও করি, আমাদের জানাজাটা হবে, কিন্তু ওখানে (মিয়ানমার) তো জানাজাটাও হবে না।’

সংগত কারণেই প্রশ্ন আসে, কেন বাংলাদেশ চুক্তিটি করেছিল? অনেক বিশ্লেষক এই চুক্তিটি অকার্যকর বলে মনে করছেন। তাঁদের এই দাবির যৌক্তিকতা অনেকাংশে থাকলেও প্রশ্ন হচ্ছে, কোন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ চুক্তিটি সম্পাদন করেছিল? সেই সময়ে বাংলাদেশের সামনে কি কোনো বিকল্প ছিল? ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর বহুপক্ষীয় কূটনীতি কিংবা জাতিসংঘ এই গণহত্যা বন্ধে এবং মিয়ানমারের ওপর সত্যিকার অর্থে চাপ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে।

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ সংস্থা নিরাপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়ার বাধার মুখে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধসহ কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নেওয়া যায়নি। ভারত ওই সময় মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপকে ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’ বলে সমর্থন করেছিল। অন্যান্য বিশ্বশক্তিও মুখে অনেক কিছু বললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আঞ্চলিক সংস্থা আসিয়ানও ঐকমত্যের অভাবে এমনকি একটি বিবৃতি দিতেও ব্যর্থ হয়েছে। আসিয়ান অত্যন্ত কার্যকর আঞ্চলিক ফোরাম হিসেবে পরিচিত। অথচ সংস্থাটি নীরবতার সুফল হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হলেও মানবাধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এটি ব্যর্থ হয়েছে।

যদিও বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সংকটকে তুলে ধরেছে, কিন্তু চীন ও ভারত বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশ কিংবা মানবতার পক্ষে ছিল না। ভূ-কৌশলগতভাবে বাংলাদেশ দুটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আঞ্চলিক এই শক্তিগুলোর আচরণ দেখে মনে হয়েছে, মানবতা এবং বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্বের চেয়েও মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক এবং রাখাইনের অর্থনৈতিক জোন তাদের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ।

গণহত্যা, জাতিনিধন বন্ধে জাতিসংঘের একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি হাতিয়ার ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রটেক্ট’ বা আরটুপি থাকা সত্ত্বেও রাখাইনে গণহত্যা বন্ধ হয়নি। সংগত কারণেই এই আন্তর্জাতিক চুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

উল্লিখিত দুর্বল বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার কারণে চীনের মধ্যস্থতায় (পর্দার আড়ালে) বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিটি সম্পাদন করে। এই চুক্তি নিশ্চিতভাবে চীন ও মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ কমিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই চুক্তির একটি বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, গ্যারান্টি ক্লোজের অভাব। যেহেতু দুটি রাষ্ট্রের ওপরই চীনের প্রভাব রয়েছে। তাই চীন রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের জন্য এই চুক্তি বাস্তবায়নে গ্যারান্টর বা জিম্মাদার হিসেবে থাকতে পারত। চীন রাজি না হলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের সঙ্গে নতুনভাবে আলোচনা করে বর্তমান চুক্তির সঙ্গে আরও কিছু নতুন ধারা সংযোজন করে রোহিঙ্গাদের বৈধ দাবি যেন প্রতিফলিত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

যেহেতু এখানে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের কথা বলা হয়েছে, তাই বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ওপর জোর প্রয়োগ করতে পারবে না। আর রোহিঙ্গারা যদি নিজ দেশে ফিরে গিয়ে সেই একই অত্যাচার, গণহত্যা এবং নির্যাতনের মুখোমুখি হয়, তাহলে একটি বিষ চক্রের মতো রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশ কিছুকাল পরপরই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। তাই আরটুপির আলোকে রাখাইনে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র অর্থনীতি হয়েও প্রায় ১২ লাখ লোককে আশ্রয় দেওয়ার নজির সৃষ্টি করেছে। রোহিঙ্গাদের উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, আর্থসামাজিক, জনসংখ্যাতাত্ত্বিক রদবদল এবং পরিবেশগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক মহল/জাতিসংঘকে অবশ্যই বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতার কথা উপলব্ধি করতে হবে।

সবশেষে বলা যায়, গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিজে) মিয়ানমারের গণহত্যা এবং জাতি নিধনের বিরুদ্ধে যে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে, তা কিছুটা হলেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশিসহ আন্তার্জাতিক সম্প্রদায়কে আশার আলো দেখিয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই সমাধানের জন্য ‘নিরাপদ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন’ হচ্ছে প্রথম ধাপ। আর এই প্রত্যাবর্তনকে শুধু কাগজে না রেখে দিনের আলোয় দেখতে চাইলে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় চুক্তির কার্যকর প্রয়োগের পথে যেতে হবে। এই সংকটের সমাধান করতে হবে এমনভাবে, যেখানে জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থা এবং বিশ্ব শক্তিগুলো তাদের স্ব স্ব ভূমিকা পালন করবে।

ড. এম জসিমউদ্দিন: সহযোগী অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি, কো-অর্ডিনেটর, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়