স্বতন্ত্র কণ্ঠ, বর্ণাঢ্য জীবন

শিল্পী মুর্তজা বশীর। জন্ম: ১৭ আগস্ট ১৯৩২। মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ২০২০। গত বছরের ১৭ আগস্ট রাজধানীর মনিপুরি পাড়ার নিজ বাসভবনে।
ছবি: খালেদ সরকার

চলে গেলেন মুর্তজা বশীর, ১৯৫০–এর দশকের একঝাঁক প্রতিভাবান শিল্পীর শেষজন, সম্ভবত সবচেয়ে বর্ণাঢ্য চরিত্রের মানুষটি। অবসান হলো বাংলাদেশের দৃশ্যকলাজগতের সূচনাপর্বের একটি তারকাখচিত যুগ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতার সূত্রে ২০ বছরের অধিক সময় শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গ আমার জীবনের এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ১৯৭৪ সালে যখন শিক্ষকতায় যোগ দিলাম, তখন আমার চার তারকা সহকর্মী বয়সে আমার চেয়ে অনেকটাই বড়। রশিদ চৌধুরী ও দেবদাস চক্রবর্তীকে আগে থেকে চিনতাম। নাট্যকলার জিয়া হায়দারের সঙ্গেও খানিক পরিচয় ছিল। মুর্তজা বশীরের সঙ্গে ছিল না। এঁদের মধ্যে অপরিচয় আর দুরধিগম্যতার বেড়া ডিঙিয়ে মুর্তজা বশীরের সঙ্গেই সম্পর্ক ধীরে ধীরে হয়ে উঠল প্রায় বন্ধুপ্রতিম।

১৯৯৭ সালে মুর্তজা বশীরের অবসর গ্রহণ ও কয়েক বছর পর স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে যাওয়ার পর যোগাযোগ কমেছে, তবে কখনোই একেবারে বন্ধ হয়নি। আজ মৃত্যু এসে চিরবিচ্ছেদ রচনার প্রেক্ষাপটে দৃশ্যশিল্প ও সৃজনকলার বিবিধ এলাকায় বিচরণ করা বশীর ভাইকে নানা অনুভবে স্মরণ করি।

স্মরণে আনি দীর্ঘ প্রায় আড়াই দশক সহকর্মী হিসেবে তাঁর সাহচর্যের অম্লমধুর স্মৃতি। মুর্তজা বশীর এমন একটি চরিত্র, পছন্দ বা অপছন্দের সীমাকে ডিঙিয়ে যিনি স্মৃতির কোঠায় স্থায়ী ছাপ রেখে যেতে পারেন। বয়সের ভার কিংবা অসুস্থতা নিষ্ক্রিয় করতে পারে, এমন মানুষ তিনি নন। শেষ তাঁকে দেখতে গিয়েছি সম্ভবত ছয়–সাত মাস আগে। অক্সিজেন সিলিন্ডার ছাড়া চলতে পারেন না, ৮৭ বছরের মানুষটি তখন বলছেন ২০টি ক্যানভাস তৈরির কথা, ছবি এঁকে প্রদর্শনী করার কথা। এমনই এক ব্যতিক্রমী চরিত্র ছিলেন তিনি।

মুর্তজা বশীরকে দেখেছি কিছুটা দুর্বিনীত, অননুমেয় মেজাজের, আত্মসচেতন, কিছুটাবা আত্মকেন্দ্রিক রূপে। আবার বাসায় কিংবা বাইরে তাঁকে সর্বত্র পেয়েছি সদা-সক্রিয় উন্মুখ মানসিকতা এবং নিরলস কর্মোদ্যমী প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা মানুষ হিসেবে। নানা বিপরীত বৈশিষ্ট্যের সমাহার এ মানুষটির সঙ্গে মতের মিলের চেয়ে অমিল হয়েছে বেশি, তবু তাঁর সাহচর্য বিস্মৃত হওয়ার নয়। এমনও হয়েছে মতানৈক্য হয়ে সম্পর্ক ছিন্ন থেকেছে দীর্ঘদিন। আবার এ অসম সখ্য এতটাই গাঢ় হয়েছে যে সারাটি দিন কেটেছে একসঙ্গে।

শহরের পথে পথে তাঁর সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে দেখেছি প্রতিটি বস্তুর প্রতি তাঁর অপার ও সজাগ কৌতূহল, একেবারে খাঁটি শিল্পীর লক্ষণ।

পরিচয়ের সূত্রপাতে তাঁর যে প্রতিভাটিতে প্রথম আকৃষ্ট হয়েছিলাম, সেটি তাঁর রেখাঙ্কনের নৈপুণ্য। সামনে বসা যে কারও মুখচ্ছবি হুবহু মিলিয়ে আঁকার বিরল দক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁর সে রেখা বাস্তবিকের প্রতিচ্ছবিতেই শেষ নয়, প্রবহমান রেখার সৃজনশীল উৎকর্ষে সমৃদ্ধ। দ্বিমাত্রিক চিত্রপটে বস্তুপুঞ্জের মধ্যে সম্পর্ককে কীভাবে একটি জ্যামিতিক বাঁধনের আওতায় আনতে হয়, সে বিষয়ে তাঁর কাছে ছাত্রের মতো শেখার আছে।

এটি স্বীকার করতেই হয় গথিক ভাস্কর্য, বাইজেন্টিনীয় মোজাইক বা ইতালির প্রাক্‌-রেনেসাঁসের চিত্রকলার আপাতপ্রাণহীন স্থবিরতার মধ্যে যে সুঠাম সমুন্নত শিল্পের ঝলকানি আছে, তা উপলব্ধির চোখ তিনিই খুলে দিয়েছিলেন।

তাঁর লেখা গল্পের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। পরিচয় ঘটল তাঁর উপন্যাস ও কবিতার সঙ্গে; চলচ্চিত্রে চিত্রনাট্যকার, সহপরিচালক ও সেট ডিজাইনার হিসেবে তাঁর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। আরও পরে মুদ্রাতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর গবেষণা তাঁকে এ বিষয়ে উপমহাদেশে পরিচিতি ও খ্যাতি এনে দেয়। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হিসেবে জেলও খেটেছেন তিনি। সৃজনশীলতার বহুমাত্রিকতায় সম্ভবত বাংলাদেশের চারুশিল্পের পরিমণ্ডলে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।

এর উল্টো পিঠে আছেন ব্যক্তি মুর্তজা বশীর। এমন আত্মপ্রেমিক মানুষ কমই দেখা যায়। আড্ডায় বা টেবিলটকে তিনি থাকলে আর কারও কথা বলার অবকাশ নেই। তাঁর কথার ফুলঝুরি কেবলই নিজেকে নিয়ে। তবে সজীব ও সরস পরিবেশনার গুণে সেসব অসম্ভব আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

তাঁর জীবনের একটি পর্যায়ে রাজনৈতিক সক্রিয়তা থাকলেও ১৯৭০–এর দশক থেকে যে বশীর ভাইকে আমরা চিনেছি, তার মধ্যে তেমন কোনো স্পষ্ট রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দেখা মেলে না। এর বদলে পাই এ অঞ্চলের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর গবেষকসদৃশ উদ্যম, প্রভূত জ্ঞান ও সচেতনতা। সে সঙ্গে বাঙালির লোককলা ও কারুকর্ম বিষয়ে গভীর আগ্রহ। তাঁর ‘এপিটাফ ফর দ্য মার্টায়ার্স’ সিরিজ চিত্রের কথা মনে রেখেই বলা, এপিটাফ যত না শহীদ যোদ্ধার প্রতি শোক-স্মরণিকা, তার চেয়ে বেশি শিল্পী মুর্তজা বশীরের ব্যক্তিগত শিল্পকাঠামো সন্ধানের ফসল। আবার যখন নতুন করে অবয়বধর্মী কাজে ফিরেছেন, সেখানে দেখি নেহাত মানবরূপের উপস্থাপনেই তিনি সন্তুষ্ট নন, বাংলার লোকচিত্রধারা পর্যবেক্ষণের মধ্য দিয়ে একটি অর্থবহ পথ রচনায় তাঁর আগ্রহ।

বাংলাদেশের শিল্পকলার পরিসরে মুর্তজা বশীর আজ অপরিহার্য ও অবশ্য-উল্লেখ্য নাম। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সদ্য বিকাশমান এই অঞ্চলের দ্বিধাগ্রস্ত শিল্পকলাকে যাঁরা পর্যাপ্ত আস্থা ও উপাদান জুগিয়েছেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। দৃশ্যশিল্পের বিভিন্ন শাখায় যেমন বিচরণ করেছেন তিনি, তেমনি সৃজনকলার অন্য দুটি মাধ্যম সাহিত্য ও চলচ্চিত্রেও রেখেছেন সৃজনপ্রতিভার স্বাক্ষর।

মুর্তজা বশীর চিত্রকলায় সব সময় স্থাপন করতে চেয়েছেন দৃঢ়তা আর পৌরুষ, ফলে প্রায় সব সময় তেল মাধ্যমের রঙেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দেয়ালচিত্র করেছেন মুর্তজা বশীর। ১৯৭৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ঝামা ইটের টুকরার মোজাইকে করা শহীদবৃক্ষ আমাদের দেয়ালচিত্রের অঙ্গনে একটি অনন্য ও শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ। একেবারে দেশীয় ঐতিহ্যকে বহন করে এমন একটি উপাদান পোড়ামাটির ইটের ব্যবহারে বশীর ভাই তাঁর চিন্তা ও প্রয়োগে বিশিষ্টতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

নানান বৈপরীত্য সত্ত্বেও ভাবনা ও মননে বশীর ভাই ছিলেন সমকালীন জগতেরই বাসিন্দা। চরিত্রগতভাবে ছিলেন মূলত নিঃসঙ্গ ও বিচ্ছিন্ন। অনেকখানি আত্মকেন্দ্রিকও। তাঁর গল্প, তাঁর উপন্যাস, এমনকি তাঁর কবিতাও মূলত আত্মজৈবনিক। ব্যক্তির অনুভূতিকে সর্বজনীন বোধে সঞ্চারিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ছবি তুলনায় অনেক বেশি সার্থক। তাঁর চিত্রভাবনা অন্য সব সৃজনকর্মের চেয়ে অনেক ব্যাপক ও অনুসন্ধানী।

মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের দৃশ্যকলাচর্চার জগতে একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠ, বর্ণাঢ্য জীবনের প্রাণময়তায় এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর তিরোধান আমাদের জীবনচর্যা ও সৃজনশীলতার জগৎকে অনেকটাই শূন্য করে দিয়েছে।

আবুল মনসুর: চিত্রশিল্পী ও শিল্পসমালোচক