স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্য দেখবে কে?

যে হাসপাতালগুলোতে সাধারণ মানুষ রোগমুক্তির স্বপ্ন দেখে, সেই হাসপাতালগুলো কি আদৌ সুস্থ আছে শুধু তার গঠনশৈলীর দিক থেকে? হাসপাতাল হচ্ছে এমন একটি স্থান, যেখানে একজন মৃত্যুপথযাত্রী নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে৷ তাই একে বলা হয় ‘স্পেস ফর হোপ’৷ অথচ আমাদের দেশের অলিগলিতে আর রাজপথের ধারে অপরিকল্পিতভাবে যেভাবে হাসপাতালগুলো গড়ে উঠছে, তাদের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ করে হাসপাতালগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকটি এখানে মূল বিবেচ্য বিষয়৷ কারণ, আবাসিক বাড়ি, অফিস স্পেস আর হাসপাতালের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার সংজ্ঞায়ন ভিন্নতর হবে, এটিই স্বাভাবিক। অথচ হচ্ছে ঠিক তার উল্টো।
ঢাকা শহরের বেশির ভাগ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান বহুতলবিশিষ্ট, পুরোটাই কাচ দিয়ে ঘেরা এবং সেই কাচের দেয়াল মোটেও খোলা যায় না। রাতের বেলায় হাসপাতালগুলোতে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে আলোকসজ্জায় বোঝার কোনো উপায় নেই এগুলো হাসপাতাল, নাকি কোনো পাঁচতারা হোটেল৷ যদিও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এগুলো করা হয়ে থাকে মূলত বাণিজ্যিক কারণে। আর স্থায়ীভাবে লাগানো কাচের কারণে কোনোভাবেই হাসপাতালের অভ্যন্তরে প্রাকৃতিক বাতাস চলাচল করতে পারে না, তাই মূলত পুরো স্থাপনাটিকেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসা হয়। যদিও একটি হাসপাতালে অবশ্যই বিশেষ বিশেষ অংশে শীতলীকরণ প্রয়োজন, কিন্তু সমস্ত স্থাপনায় শীতলীকরণ ব্যবস্থা কি আমাদের দেশের জলবায়ুর জন্য সুখকর? শুধু তা–ই নয়, এই অতিরিক্ত যান্ত্রিক শীতলীকরণ প্রক্রিয়া বিদ্যুৎ ঘাটতির ওপরেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার সব সময় তাঁর রোগীদের উপদেশ দিয়ে থাকেন প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের সঙ্গে সহাবস্থান করার জন্য, অথচ আমাদের দেশের অপরিকল্পিত চাকচিক্যের কারণে বেশির ভাগ চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বিষয়টি মাথায় না রেখে ভবনটিকে মোটা রিফলেকটেন্স কাচ দিয়ে মুড়িয়ে দিচ্ছে৷ এতে তাপমাত্রার প্রতিফলন বেড়ে যাচ্ছে অভ্যন্তরীণভাবে। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপীয় আদলে গড়ে ওঠা এসব অবকাঠামো তার আশপাশের বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে ওঠার জন্য সব থেকে বেশি ভূমিকা পালন করছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কাচ দিয়ে মোড়া একটি সুউচ্চ ভবনের চারপাশের তাপমাত্রা বাতাসের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে চার-ছয় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, যার প্রভাব পড়ছে রাস্তায় খোলা বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর; স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে ক্রমাগত। অন্যদিকে ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগা, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে পুরে মরা দেখে আমাদের গা শিউরে ওঠে, যা নিয়ে আমরা সবাই বর্তমানে কথা বলছি৷ কারণ প্রতিনিয়তই আমরা এই দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি। কিন্তু আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি, অপরিকল্পিতভাবে আবাসিক ফ্ল্যাট অথবা অফিসের আদলে বেড়ে ওঠা হাসপাতালগুলো আদতেই স্বাস্থ্যসম্মত কি না? সেখানে অগ্নিনির্বাপণের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা আছে কি না? গাড়ি পার্কিংয়ের সঠিক ব্যবস্থা আছে কি না?
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একটি বিপণিকেন্দ্র আর একটি হাসপাতাল এক বিষয় নয়। একটি বিপণিকেন্দ্রে আগুন লাগলে হয়তো মানুষ দৌড়াতে সক্ষম, কিন্তু একজন মৃত্যুপথযাত্রী, যে কিনা অচেতন অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে, তার পক্ষে কীভাবে দৌড়ানো সম্ভব? বিষয়টি নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে, বিশেষ করে স্থপতিদের। বাংলাদেশের প্রতিটি ভবন পরিবেশবান্ধব কি না, তা যাচাই-বাছাই করে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে দুঃখের বিষয় এই যে এগুলো পরিবেশবান্ধব করার সুস্পষ্ট নীতিমালা এখনো আমরা আমাদের দেশের জলবায়ু অনুযায়ী তৈরি করতে পারিনি৷ পাশের দেশ ভারত, মালয়েশিয়া এদিক থেকে অনেক এগিয়ে গিয়েছে। অন্যথায় চিকিৎসা নিতে আসা খোলা আলো-বাতাসে থাকা গ্রামের সাধারণ একজন মানুষকে এই কাচ দিয়ে মোড়ানো ‘হিট বক্স’ আসলেই কি পরিপূর্ণ চিকিৎসাসেবা দিতে সক্ষম হবে? নাকি তাদের অযথাই এসির মধ্যে রেখে এগুলো শুধু বাণিজ্যিকভাবে লাভবান হওয়ার পাঁয়তারা মাত্র।
আর এ কথা অনস্বীকার্য যে আমাদের দেশেরই নামকরা স্থপতিদের ভবনবিষয়ক কর্তৃপক্ষ এগুলো সব সময় আমলে নিচ্ছে না৷ তারা শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নিয়েই সময় পার করছে৷ পরিবেশগত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না৷ বেশির ভাগ হাসপাতালে করিডরের প্রশস্ততা, লিফটের সামনের জায়গার পরিমাণ ও সংখ্যা, ভবনের সামনের খোলা জায়গার পরিমাণ, ময়লা-আবর্জনার যথাযথ ব্যবস্থাপনা, অগ্নিনির্বাপণ, বহির্গমনের রাস্তা খোলা স্থানে উন্মুক্ত কি না ইত্যাদি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে৷ নইলে একটি হাসপাতাল সব সময় তার নিজেরই স্বাস্থ্য-সংকটে ভুগবে এবং তার চারপাশের পরিবেশ দূষিত করবে। তখন এটি রোগ নিরাময়ের কেন্দ্র না হয়ে হয়ে উঠবে মৃত্যুকেন্দ্র। হাসপাতাল-ক্লিনিক ইত্যাদি নির্মাণে কী ধরনের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে৷ কারণ বিভিন্ন উপকরণ থেকে বিভিন্ন ধরনের অস্বাস্থ্যকর রশ্মি নিঃসরিত হয়ে যেন স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব না ফেলে৷ এমনকি কোন ধরনের রং ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটিও বিবেচ্য বিষয় হতে হবে। তাই দরকার একটি সুস্পষ্ট পরিবেশবান্ধব বিধিমালা, যা হবে সম্পূর্ণ আমাদের দেশের জলবায়ুর উপযোগী৷ এবং এ ব্যাপারে সরকারকে চুপ করে বসে থাকলে চলবে না; প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে, ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তা বাদ দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে৷ সত্য হলেও অনস্বীকার্য যে প্রতিনিয়তই আমরা নিয়ম গড়ছি নিজেদের প্রয়োজনে, ভাঙছিও একই কারণে, যা দেখার কেউ নেই৷
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়৷