স্বৈরশাসকের কালো ছায়া

শহীদ শামসুল আলম খান মিলন
শহীদ শামসুল আলম খান মিলন

আজ ২৭ নভেম্বর, শহীদ ডা. শামসুল আলম খান মিলনের ২৩তম শাহাদাৎ বার্ষিকী। ১৯৯০-এর এ দিনে সামরিক স্বৈরশাসকের ভাড়াটিয়া গুন্ডাবাহিনীর বুলেট মিলনের প্রাণপ্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছিল। সেদিন আমার জীবন, আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষের জীবন ওলটপালট হয়ে গেল মিলনের অন্তর্ধানের পর।
মিলন কিশোর বয়স থেকেই সমাজসচেতন, দেশপ্রেমিক ও অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ ছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবস্থায় মিলন ছাত্রলীগ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। বিভিন্ন সময়ে মিলন ছাত্রলীগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ শাখার সাহিত্য সম্পাদক, ক্রীড়া সম্পাদক ও সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে মিলন তৎকালীন পিজি হাসপাতালে বায়োকেমিস্ট্রিতে এমফিল কোর্সে ভর্তি হয়। সে বছরই দেশে তিন পেশার অর্থাৎ চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও প্রকৌশলীদের আন্দোলন গড়ে ওঠে। মিলন এ তিন পেশা আন্দোলনের সমন্বয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিল। এ সময় মিলনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু পেশাজীবীদের সম্মিলিত আন্দোলনের মুখে সরকার ওকে চাকরিতে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হয়। অবশ্য তার পরই শাস্তিস্বরূপ রৌমারী উপজেলায় বদলি করা হয়।
মিলন তার সমগ্র সত্তা দিয়ে দেশকে ভালোবেসেছিল। অথচ আজ, শহীদ মিলনের উত্তরসূরিরা, নিজের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য পরস্পর হানাহানিতে লিপ্ত হতেও দ্বিধাবোধ করছেন না।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশ সংকটময় মুহূর্ত অতিক্রম করছে। কতিপয় রাজনীতিবিদের আচার-আচরণে মনে হয়, বাংলাদেশটা তাঁদের ইচ্ছানুযায়ী চলবে। এখানে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা বা মতামত মূল্যহীন। তাঁরাই যেন জনগণের ভাগ্যনিয়ন্ত্রক। তাঁরা ভুলে যান, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক।
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে ২২ বছর ধরে পতিত স্বৈরাচার এরশাদকে নিয়ে দেশে রাজনৈতিক খেলা চলছে। জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও এ সেনাশাসক রাজনীতির জন্য, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, আমাদের নেতা-নেত্রীদের কাছে অপরিহার্য শক্তিরূপে বিবেচিত হচ্ছেন কেন?
শিল্পী কামরুল হাসান যাঁর কার্টুন এঁকেছিলেন ‘বিশ্ববেহায়া’ আখ্যায়িত করে। নব্বইয়ের পরে দেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল যাঁর বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিল, সেই স্বৈরশাসক আজ এ দুটি দলের কাছেই নির্বাচনের আগে জামাই-আদরে আদৃত হচ্ছেন। ‘ক্ষমতায় যাওয়া আর ক্ষমতায় থাকার নীতিহীন রাজনীতির’ খেলায় বাংলাদেশের রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে বলেই এমনটা সম্ভব হচ্ছে।
মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের পর ‘সংসদীয় রীতিনীতি যেন এক ব্যক্তির ইচ্ছার কাছে পরাস্ত হলো’। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারব্যবস্থা নেই। তথ্যমন্ত্রী বর্ণিত ‘বহুদলীয় সরকারব্যবস্থাও’ নেই। বাংলাদেশের সংবিধানেও নেই। তাই ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ বলে যাঁরা জোর গলায় দাবি করছেন, তাঁরা কি সত্যের অপলাপ করছেন না? নির্বাচনে কৌশলগত কারণে এবং সামরিক সরকারপ্রধান জেনারেল এরশাদকে তুষ্ট রাখার উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় সরকারের মন্ত্রিসভায় জাতীয় পার্টি পাঁচজনকে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং আর একজনকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছে। স্বৈরশাসক এরশাদের জাতীয় পার্টি ছয়টি আসন পেয়ে ‘সর্বদলীয় মন্ত্রিসভায়’ সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এমনকি স্বৈরাচারী আমলের ফার্স্ট লেডি সর্বদলীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছেন। এ সংবাদ বাংলাদেশ চিকিৎসকসমাজের জন্য লজ্জাজনক।
বহুরূপী জেনারেল এরশাদ, সম্প্রতি ‘হেফাজতে ইসলামের’ প্রধান মাওলানা শফীর সঙ্গে ঐক্যজোট বেঁধে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন বলে পত্রিকায় সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য তাঁর দোয়া কামনা করেছেন। এতে নারীবিদ্বেষী মৌলবাদী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবে ভণ্ডামির রাজনীতি।
দেশের একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে সাবেক স্বৈরশাসকের পুনরুত্থান দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কোন অশুভ ছায়াপাত করবে, তা ভেবে দেশবাসী আতঙ্কিত ও শঙ্কিত।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিছু সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী, আমলা ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার অনুপ্রবেশ, রাজনীতিকে করেছে বিপথগামী, কলুষিত ও আদর্শচ্যুত। রাজনীতিবিদদের মধ্যে এখনো যাঁরা আদর্শের রাজনীতি করেন এবং আদর্শিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তাঁদের প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ, বাংলাদেশে ২২ বছর ধরে ক্ষমতাবদলের যে নীতিহীন রাজনীতি চলছে, তা থেকে দেশকে রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধভাবে সচেষ্ট হোন। নতুবা এ দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি করা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও দুরূহ হয়ে উঠবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে দেশে সুষ্ঠু, সুন্দর রাজনৈতিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের তরুণসমাজকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে হবে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হলে নতুন নেতৃত্বকে জায়গা দিতে হবে রাজনীতিতে।
তবেই শহীদেরা যে আকাঙ্ক্ষা বুকে নিয়ে এ দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন, তা সার্থক হবে।
সেলিনা আখতার: শহীদ মিলনের জননী।