স্বৈরাচার বনাম সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ

একঘেয়ে শোনালেও বলতেই হবে, যত দিন লাগুক সিরিয়ার জনগণকেই কাজটা করতে হবে। কিন্তু ওবামা প্রশাসন যেভাবে গত কয়েক দিনে পাগলপারা হয়ে উঠেছে! গত সপ্তাহে রাজধানী দামেস্কের শহরতলিতে বেসামরিক জনগণের ওপর রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। আর এই অভিযোগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই আসাদ পতনের হামলা যখন-তখনের ব্যাপার হয়ে উঠেছে। আরও একবার যুদ্ধজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে হোয়াইট হাউস।

নিজের দেশে জনমত ভয়াবহভাবে বিরুদ্ধে, আরেক প্রভাবশালী দেশ ফ্রান্সেও তা-ই। প্রধান মিত্র ব্রিটেনের পার্লামেন্টে সিরিয়ার ওপর সামরিক হামলার প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেছে। তবু একগুঁয়ে অবস্থানে ওবামা। ২০১১ সালে লিবিয়ায় হামলা চালানোর সময় আইনসভার সম্মতি না নেওয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন। এবার তাই কংগ্রেসের সম্মতি নেওয়ার কথা বলছেন। আবার এ কথাও বলে রাখছেন যে কংগ্রেসের সম্মতি ছাড়াও সামরিক হামলার সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নাকি তাঁর হাত আছে। ৭ তারিখে আইনসভার কাজ শুরু হলে কী হবে বলা যায় না। কংগ্রেসে পাস হয়ে গেলে তো কথাই নেই; পাস না হলেও যদি হামলা চালিয়ে বসেন? শীর্ষ সামরিক উপদেষ্টা নাকি হোয়াইট হাউসের লনে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পায়চারি করতে করতে জানিয়ে দিয়েছেন যে এক মাস পরে হামলা হলেও অসুবিধা নেই। বোঝা যাচ্ছে যে সিরিয়া কর্তৃপক্ষকে (আসলে সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষকে) আটকে রাখা শ্বাস ছাড়তে দিতে চায় না ওবামা প্রশাসন। অবশ্য ওবামার মুখের কথাগুলো তাঁর (ওবামার) মনের কথা কি না কে জানে। আমেরিকাতে চোখে দেখা যাওয়া রাষ্ট্রযন্ত্র ছাড়াও চোখে না দেখা যাওয়া একটি রাষ্ট্রযন্ত্রও যে আছে, এটা সবাই জানেন ‘ডিপ স্টেট’ কথাটা বেশ।

গত সপ্তাহে আদৌ রাসায়নিক হামলা হয়েছে কি না, সে ব্যাপারেই এখনো কোনো তথ্য দেয়নি জাতিসংঘের পরিদর্শক দল। গত শনিবার সিরিয়া থেকে এসে তারা জানিয়েছে, পরীক্ষাগার থেকে এ ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পেতে দুই সপ্তাহের মতো লাগবে। আরও কথা আছে, ধরা যাক প্রমাণিত হলো যে রাসায়নিক হামলা চালানো হয়েছে কিন্তু হামলাটি কে চালিয়েছে, তা তো জাতিসংঘ পরিদর্শক দলের সংগৃহীত নমুনাদি থেকে বলা যাবে না। এর জন্যও সময় প্রয়োজন। ওবামা প্রশাসন রাসায়নিক হামলা এবং হামলায় আসাদ বাহিনীর জড়িত থাকার অকাট্য প্রমাণের কথা বলছে। এসবই ইরাক হামলাকালীন মিথ্যাচারের পুনরাভিনয় মনে হচ্ছে। সেবার বুশের দোসর ছিলেন ব্লেয়ার। এবার শুরুতে ওবামার সঙ্গে চড়া গলায় সুর মেলালেও পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের পরে আপাতত মিইয়ে গেছেন ক্যামেরন।

ধরা যাক, রাসায়নিক হামলা হয়েছে এবং আসাদ বাহিনী হামলা করেছে। তার পরেও বড় প্রশ্নটি থেকে যাবে—তাই বলে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর কে? রাশিয়া ও চীনের আপত্তির কারণে সুবিধা হবে না জেনেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ম্যান্ডেট নেওয়ার ব্যাপারটিকে সরাসরি অগ্রাহ্য করা হচ্ছে। আর কয়েক দিনের মধ্যেই ধনী দেশগুলোর জোট জি-২০-এর সম্মেলন হবে সেন্ট পিটার্সবার্গে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হামলার কড়া বিরোধিতা করার সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়া প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য জি-২০ ব্যবহারের কথা বলছেন। ভালো প্রস্তাব, কিন্তু ওবামার কানে গেছে বলে মনে হয় না।

সিরিয়া কর্তৃপক্ষ বারবার বলছে যে গত সপ্তাহে কোনো রাসায়নিক হামলা হয়নি। তারা বরং গত মে মাসের একটি হামলায় সরকারবিরোধীরা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে বলে দাবি করছে। আসাদের সরকার নিজেরা ভয়াবহ দুষ্কৃতকারী হলেও তাদের এ অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে শোনা দরকার। কারণ, আসাদবিরোধীরা তো আর ধোয়া তুলসী পাতা নয়। এরা সব ধর্মীয় উগ্রবাদী। আসাদরা শিয়া আর এরা সুন্নি। অন্তর্ধর্ম বিভেদকে গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্রের লড়াই বলে চালিয়ে দিচ্ছে এরা। আসাদ হচ্ছে স্বৈরাচারী। কিন্তু এরা কোথাকার কোন গণতন্ত্রী?

সিরিয়ায় সরকারবিরোধীদের মধ্যে নানা লাইনের ধর্মীয় উগ্রবাদীদের মধ্যে আল-কায়েদা লাইনের সংগঠন বেশ ভালোভাবেই আছে। অথচ কী আশ্চর্য, আল-কায়েদা বিনাশে দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এদেরকেই ব্যাপক সমর্থন দিতে দেখা যাচ্ছে—অস্ত্র, অর্থ, গোয়েন্দা তথ্য সবকিছু দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের আরও একটি দেশ যদি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়, তাহলে পশ্চিমের কী লাভ? আর একটা ব্যাপার জাতিসংঘ রাসায়নিক অস্ত্র পরিদর্শক দল, যাদের আসাদ ডেকে নিয়ে গেছেন, সিরিয়ায় থাকা অবস্থায় তাদের নাকের ডগাতেই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করল আসাদ বাহিনী! এত বড় নির্বুদ্ধিতা আসাদ বাহিনী কেন করবে? আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার যদি হয়েই থাকে, তাহলে সেটা আসাদবিরোধীরাই করেছে? মার্কিন মদদে? আসাদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলার জমিন তৈরি করার স্বার্থে? এ লাইনে ভাবনাচিন্তা করার লোকজনকে পাওয়া যাচ্ছে সারা বিশ্বে। স্মর্তব্য, গত মে মাসে এক হামলায় সরকারবিরোধীদের দ্বারা নিষিদ্ধ নার্ভ এজেন্ট সারিন ব্যবহূত হয়ে থাকতে পারে বলে গুরুত্বের সঙ্গে মত প্রকাশ করেছিলেন জাতিসংঘের হয়ে পরিদর্শক কমিশনের অন্যতম সদস্য কার্লা দেল পন্টে।

সিরিয়ায় অশুভের সঙ্গে অশুভের সংঘাত চলছে। খারাপের বিরুদ্ধে খারাপ; স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মৌলবাদ। আবার মৌলবাদের সমর্থনে সাম্রাজ্যবাদ। এমতাবস্থায় যা করা যায় তা হচ্ছে সিরিয়ার মাটিতে সাম্রাজ্যবাদী হামলার বিরোধিতা। যা করা যায় তা হচ্ছে সিরিয়ার মাটিতে আসাদ সরকারের স্বৈরাচারী শাসনের বিরোধিতা, যা করা যায় তা হচ্ছে ধর্মীয় উগ্রবাদীদের তৎপরতার বিরোধিতা। আবেগ-উত্তেজনা কিংবা খামখেয়ালিপনার বশবর্তী হয়ে এই নৃশংস ঘটনাপ্রবাহে কোনো একটি পক্ষকে এতটুকু সমর্থন দেওয়ার অবকাশ এতটুকুও নেই।

শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।