সড়কে 'মৃত্যুফাঁদ'

সড়কে ‘মৃত্যুফাঁদ’
সড়কে ‘মৃত্যুফাঁদ’

গত বছরের অক্টোবরের এক শনিবারের সন্ধ্যা। রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে ক্যাথরিন মাসুদ যখন কথা বলতে উঠলেন, তখন অনুষ্ঠান একেবারে শেষের দিকে। তারেক মাসুদের মৃত্যুর দুই বছরেও বেশি হয়ে গেছে। সময়ের আবহে শোকের তীব্রতা হয়তো কিছুটা কমে এসেছে। তার পরেও সেটা গোপন থাকে না কথার ফাঁকে ফাঁকে ফেলা ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাসে। ক্যাথরিন কথা বলছিলেন মৃত্যুফাঁদ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে। এই প্রামাণ্যচিত্রটিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আমাদের সনাতন ধারণার বাইরের এক অজানা বিস্ময়কর চিত্র।
তারেক মাসুদ বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার বলি লাখ লাখ মানুষের মধ্যে একজন। তাঁর মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই দেশজুড়ে একটি আলোড়ন তৈরি হয়। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আন্দোলন, সেমিনার, লেখালেখি অনেক কিছু হয়। গত দুই বছরেরও বেশি সময় সেটা অনেকখানিই স্তিমিত হয়ে এসেছে। কিন্তু যেটা থামেনি সেটা হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায় নিয়মিত নিহতের সংখ্যা। দুর্ঘটনা বাংলাদেশে আসলে কোনো দৈব ব্যাপার নয়। যে
দেশে সাইনবোর্ডে লেখা থাকে ‘সাবধান, সামনে দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা’, তখন দুর্ঘটনা হয়ে যায় একটি অতি প্রত্যাশিত ঘটনা। মৃত্যুফাঁদ নামক প্রামাণ্যচিত্রটি এটাই দেখিয়েছে যে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার বেশির ভাগ আসলে আমাদের অজ্ঞতা, অবহেলা আর অপরিণামদর্শী আচরণের কারণে তৈরি এক পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
পুলিশের যে রিপোর্ট হয় সেখান থেকে দেখা যায় যে প্রতিবছর কমপক্ষে তিন হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। পুলিশি রিপোর্ট যে প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী এই সংখ্যাটি ১২ হাজার থেকে ২০ হাজার হাজার হতে পারে। তার মানে আমাদের দেশে প্রতিবছর দিনে গড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ জন।
এই মৃত্যু উপত্যকার প্রধান কারবারি হিসেবে অবশ্যম্ভাবী হিসেবে প্রথমেই ‘ঘাতক’ চালকের প্রসঙ্গ চলে আসে। আমাদের মাঝে গাড়িচালকদের সম্বন্ধে একটা চিত্র আছে। সেটা হলো যে বাস আর ট্রাকচালক হলেন এমন এক ক্রিমিনাল প্রজাতি, যাঁরা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য শতভাগ দায়ী। তাঁরা উল্টাপাল্টা চালান, কেউ কেউ মদ খেয়ে গাড়ি চালান, উল্কাগতিতে গাড়ি চালান আর দুর্ঘটনা ঘটিয়ে, মানুষ মেরে সটকে পড়েন।
এটা যে পুরোপুরি অমূলক, তা-ও কিন্তু নয়। মৃত্যুফাঁদ-এ রয়েছে সেই পরিবারের কাহিনি, যেখানে বাবা তাঁর সন্তানকে হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। সেই বাবাই আবার দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। রয়েছে সেই মায়ের কাহিনি, যার একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে পৃথিবী শূন্য হয়ে গেছে। এই পরিবারগুলোর স্বাভাবিকভাবেই চালকশ্রেণীর মানুষের ওপর একটা অসম্ভব রকমের ক্ষোভ থাকতে পারে। কিন্তু ভিলেনের তকমা পাওয়া চালকদেরও যে সড়ক দুর্ঘটনার ব্যাপারে অন্য একটি চিত্র রয়েছে, সেটি এই প্রথম উঠে এসেছে এই প্রামাণ্যচিত্রে।
মৃত্যুফাঁদ-এ রয়েছে সেই চালকের কথা, যাঁর বাঁ হাঁটু পাঁচ টুকরা হয়ে যায় যাত্রীদের বাঁচাতে গিয়ে। পরিণামে তাঁর এখন বাকি জীবন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এ তো গেল একজন চালক, যে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তার পরও তিনি বেঁচে রয়েছেন, পরিবার কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু যে চালক গাড়ি চালাতে গিয়ে একেবারে মরেই গেলেন, তাঁর পরিবারের কী হতে পারে?
চালকদের কথা হচ্ছে, তাঁদের ঘাতক বলা হবে কেন? দুর্ঘটনা তো তাঁরা চিন্তাভাবনা করে করেন না। একটা দুর্ঘটনায় তাঁর মরে যাওয়ার আশঙ্কা যাত্রীদের চেয়ে কোনো অংশে কম না। বরং বেশি। তাহলে কেন তিনি খামাকা এই ঝুঁকি নিতে চাইবেন? তাঁর নিজের ভালোমন্দের কথা না ভাবলেও নিদেনপক্ষে পরিবারের কথা চিন্তা করেও তো তাঁর এই ব্যাপারে সতর্ক থাকার কথা। এর একটি বাস্তবসম্মত উত্তর উঠে এসেছে মৃত্যুফাঁদ-এর মধ্যে চিত্রিত বিভিন্ন অনুসন্ধানী বিশ্লেষণে। চালকদের পেশাগত পরিস্থিতি বাংলাদেশে এমন একপর্যায়ে যে বাস বা ট্রাকের চালকেরা আসলে সতর্ক থাকার মতো শারীরিক বা মানসিক অবস্থার মধ্যেই থাকেন না।
আমরা কতজন নিজেরা কখনো গাড়ি চালিয়ে দেখেছি? দেশের বাইরে আমার লম্বা পথ গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। আর সেখানকার রাস্তায় কোনো ঝামেলা নেই, গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগি, নছিমন, করিমন, ভটভটির বিচিত্র সমাহার সেখানে নেই। তার পরও দু-তিন ঘণ্টা একটানা গাড়ি চালালেই একটা অবসাদ চলে আসে। আর বাংলাদেশের রাস্তায় যদি আপনি চার-পাঁচ ঘণ্টা চালান, তাহলেই তো মাথা খারাপ
হয়ে যাওয়ার কথা। আর সেখানে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আমাদের চালকেরা কখনো টানা ২৪ ঘণ্টাও গাড়ি চালান। মালিকের কাছে এই চালকেরা শুধু টাকা বানানোর আরেকটা উপাদান মাত্র। আর দুর্ঘটনা ঘটলে তো মালিকের কোনো দায় নেই। চালকদের চাকরি কোনো মাসিক বেতনের নয়। এখানে কোনো নিয়োগপত্র নেই। নেই পেনশন বা চাকরির নিরাপত্তা। এখানে টাকা ট্রিপ অনুযায়ী। যে যত ট্রিপ মারতে পারেন, তত টাকা। এই ট্রিপ পদ্ধতি চালু করে চালকদের বানিয়ে ফেলা হয়েছে এক যান্ত্রিক গাড়ি চালানোর মেশিনে।
চালকদের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ, তাঁরা ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালান। এ নিয়ে মৃত্যুফাঁদ-এ রয়েছে বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি) অফিসে লাইসেন্স নিতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে যাওয়া একাধিক চালকের সাক্ষাৎকার। তিনি সৌদি আরব, কাতার এসব জায়গায় ড্রাইভিং করেছেন। সেখানে এক-দুই সপ্তাহের মধ্যে ড্রাইভিং লাইসেন্স পেয়ে গেছেন। অথচ ড্রাইভিংয়ের এত বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বাংলাদেশে এক বছর ধরে ঘুরছেন কিন্তু লাইসেন্স পাচ্ছেন না। ঘুষ দিলে অবশ্য এটা কোনো ব্যাপারই নয়।
চালকদের শিক্ষার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু ভালো চালকদের সঙ্গে উচ্চশিক্ষিত হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। আর আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেটা কিন্তু অনেকখানিই অযৌক্তিক। আমাদের দেশের বাস্তবতায় যেটি দরকার সেটি হলো একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া, যেটার মাধ্যমে চালকেরা লাইসেন্স পেতে পারেন। কিন্তু বিআরটিএর সেই ধরনের কোনো ইচ্ছা আছে বলে মনে হয় না। তারা চায় একটা অবৈধ পন্থা বজায় রাখতে। কারণ, তাহলে উপরি আয়ের সুযোগ সব সময় থেকেই যায়।
সড়ক দুর্ঘটনার আরেকটি নিয়ামক হলো সড়কের ওপর অত্যধিক চাপ। আর সেটি হয়েছে বছরের পর বছর রেলপথ আর জলপথকে যোগাযোগের মাধ্যম থেকে অবহেলা করার জন্য। মৃত্যুফাঁদ-এ আমরা দেখি এই ভয়াবহ চিত্র কী করে এই দুটো যোগাযোগ মাধ্যমকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার মাধ্যমে সড়কের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে বেশ কিছু মতবাদ আছে। আছে গাড়ি-বাস মালিকদের স্বার্থ, যাদের অনেকেই দেশের নীতিনির্ধারণে যুক্ত। থাকতে পারে বিদেশি দাতা রাষ্ট্রের স্বার্থ, যেখানে বৈদেশিক সাহায্য আর বিনিয়োগ সব সড়ক আর সেতু নির্মাণে, যাতে গাড়ি আমদানি বৃদ্ধি পায়।
ড. রুশাদ ফরিদী: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাগরীর একজন সদস্য।
[email protected]