হাসিনার সফরে বাংলাদেশ কী পাবে

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা     ও       জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে

চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন জাপানে৷ ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের জন্য এটা হবে বিশ্বের অগ্রসর অর্থনীতির রাষ্ট্রগুলোর জোট জি-সেভেনের একটি দেশে প্রথম সরকারি সফর। সেদিক থেকে এই সফরের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের জন্য অপরিসীম। কেননা, প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের মধ্য দিয়ে জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে যাওয়া পশ্চিমা বিশ্বের দুয়ার বাংলাদেশ সরকারের সামনে নতুন করে উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে, যা আমাদের অর্থনীতি আর পররাষ্ট্রনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে আবার ভারতের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে স্বস্তি-অস্বস্তির দোলাচল চলছে৷ এ রকম একটি সময়ে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফর মনে হয় সরকারের নীতিনির্ধারকদের সামনেও এ কারণে আশীর্বাদতুল্য হয়ে দেখা দিতে পারে যে, এই সফরের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের নিষ্পত্তি পুরোপুরি না হলেও তারা যে বাংলাদেশকে বর্জনের চিন্তাভাবনা করছে না, সেই বার্তা প্রচারিত হওয়া আঞ্চলিকভাবেও বাংলাদেশের অবস্থানকে হয়তো আরও কিছুটা শক্ত করে তুলবে। ফলে জাপান সফরের প্রাপ্তির ভান্ডার যেন কোনো অবস্থাতেই ফাঁকা না থাকে, সেই চেষ্টাই থাকবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরকে সত্যিকার অর্থে সফল করে তুলতে চাইবে তারা৷
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য জাপানের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশের অর্থনীতিতে নতুনভাবে গতি সঞ্চার করতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত পোশাক খাতের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে অর্থনীতি, বিশেষ করে অর্থনীতির উৎপাদনশীল খাতকে বহুমুখী করে তোলা আবশ্যকীয়। জাপানি বিনিয়োগ সেখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম।
জাপানের বিনিয়োগকারীরা এ মুহূর্তে চীনের বিকল্প একটি বিনিয়োগ গন্তব্যের সন্ধানে আছেন। পূর্ব এশিয়ায় ভূখণ্ডগত দাবি-দাওয়া নিয়ে
নতুন করে দেখা দেওয়া উত্তেজনাকর পরিস্থিতির আলোকে চীন-জাপান সম্পর্ক তিক্ত হয়ে আসায় চীনের ওপর আস্থা রাখা এখন আর সেভাবে সম্ভব নয় বলে জাপানের ব্যবসায়ী মহল মনে করে। ফলে দীর্ঘদিনের বন্ধ দুয়ার খুলে দেওয়া মিয়ানমারের পথে জাপানি বিনিয়োগকারীরা অতি সম্প্রতি দল বেঁধে অগ্রসর হতে থাকলেও মিয়ানমারের পক্ষে চীনের বিকল্প হয়ে ওঠা কতটা সম্ভব, সেই প্রশ্ন তাঁদের অনেকে এখন করতে শুরু করেছেন।
এ ছাড়া, মিয়ানমারের অমীমাংসিত রাজনৈতিক ও জাতিগত দ্বন্দ্ব, আর সেই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় দেশটির অভিজ্ঞতার ঘাটতি থেকে দেখা দেওয়া নানা রকম সমস্যা বিনিয়োগ-উৎসাহে ভাটার টান দেখা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে দিচ্ছে বলে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। ফলে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশের জন্য দরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি জাপানকে দেওয়া, যা কিনা জাপানি বিনিয়োগকারীদের এ রকম আশ্বাস দিতে পারে যে বাংলাদেশ আসলেই হচ্ছে তাঁদের জন্য অপার সম্ভাবনাময় এক গন্তব্য। বিশেষ করে, আমাদের বিনিয়োগ অবকাঠামো এবং বিদেশি বিনিয়োগসংক্রান্ত আইনের কিছু কিছু দিক নিয়ে জাপানের বাণিজ্যিক মহলের অসন্তুষ্টি অনেক দিনের। সেসব দিকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের অঙ্গীকারই কেবল নয়, একই সঙ্গে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত জাপানি বিনিয়োগকারীদের কাছে তুলে ধরা হলে অনেক সহজে তাঁদের আশ্বস্ত করা সম্ভব হবে।
কূটনৈতিক দিক থেকে অবশ্য তুলনামূলক ভালো অবস্থান বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে। শীর্ষ পর্যায়ে সফর বাস্তবায়িত হওয়াটাও বড় ধরনের কূটনৈতিক অগ্রগতি। কেননা, এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের বন্ধ দুয়ার খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা যে সরকারের সামনে দেখা দিয়েছে, সেই উল্লেখ তো শুরুতেই করা হয়েছে। সেই সাফল্যের সূত্র ধরে আরও কিছুটা অগ্রসর হতে হলে সুস্পষ্ট কিছু ইঙ্গিত জাপানকে দেওয়া দরকার, যার সবগুলোই বাংলাদেশের জন্য সুখকর না–ও হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন জাপানের বর্তমান সরকার সাংবিধানিক ব্যাখ্যা রদবদল করে নিয়ে সম্মিলিত আত্মরক্ষা অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দেশের জন্য করে দেওয়ার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, অনেক দেশ, বিশেষ করে জাপানের নিকট প্রতিবেশীরা তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। সেসব দেশ মনে করছে, জাপানের এই নব্য জাতীয়তাবাদী চেতনা দেশকে ত্রিশের দশকের মতোই সমরবাদের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা পূর্ব এশিয়ার সার্বিক নিরাপত্তার সামনে ঝুঁকি হয়ে দেখা দিতে পারে।
সরকারিভাবে এ বিষয়ে জাপানের অবস্থান হচ্ছে এ রকম যে, জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ সংবিধানের সনাতন ব্যাখ্যায় বাধা হয়ে দেখা দেওয়ায় এবং মিত্র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমপর্যায়ের নিরাপত্তা অংশীদারি গড়ে নেওয়ার লক্ষ্যে সাংবিধানিক ব্যাখ্যার বিষয়টি ঠিক করে নেওয়া দরকার। বাংলাদেশ যেহেতু জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচির খুবই সক্রিয় এক অংশগ্রহণকারী, ফলে জাপান হয়তো এ বিষয়ে বাংলাদেশের পরোক্ষ সমর্থন প্রত্যাশা করতে পারে। তবে ঝুঁকির দিকটি এখানে হচ্ছে এমন যে, বাড়তি যেকোনো রকম সমর্থন বা অঙ্গীকার চীনের উৎকণ্ঠা হয়তো বাড়িয়ে দেবে, আমাদের অর্থনীতি, কূটনৈতিক অবস্থান ও সামাজিক প্রেক্ষাপট—কোনোটার জন্যই যা কি না কল্যাণকর নয়। ফলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে জাপানের বর্ধিত অংশগ্রহণের পক্ষে বলিষ্ঠ বক্তব্য দেওয়ার পাশাপাশি আঞ্চলিক বিভিন্ন বিরোধের কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় জাপান ও প্রতিবেশীদের জড়িত হওয়াকে স্বাগত জানানো হতে পারে পূর্ব এশিয়ার ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে আসা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে জুতসই অবস্থান। জাপানের খুবই ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর জোট আসিয়ানকেও অনেকটা সে রকম এক রজ্জু পথ ধরে এখন এগোতে হচ্ছে।
অন্যদিকে জাপানের বাজারের প্রতিশ্রুতিশীল যে দিকটি থেকে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেটা হচ্ছে জাপানের শ্রমের বাজার। জনসংখ্যার অব্যাহত নিম্নমুখী ধারা থেকে বেশ কিছু খাতে শ্রমের ব্যাপক ঘাটতি জাপানে ইদানীং দেখা দিচ্ছে। সেই ঘাটতি পূরণ করে নিতে বিদেশের জনশক্তির জাপানে প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া নিয়ে জাপান সরকারকে আজকাল ভাবতে দেখা যাচ্ছে। সেবা খাতে সেবিকা পাঠানোর চুক্তি ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কয়েক বছর আগেই জাপান স্বাক্ষর করেছে। ফলে সেসব দেশের নার্স ও সেবাকর্মীরা কতিপয় শর্তের আওতায় জাপানে আসার সুযোগ পাচ্ছেন।
নির্মাণ খাতে শ্রমের ঘাটতি হচ্ছে আরেকটি দিক, বাংলাদেশের জন্য যা কিনা নতুন সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে। ২০১১ সালের ভূমিকম্প ও সুনামিবিধ্বস্ত এলাকাগুলোর পুনর্নির্মাণ ও সেই সঙ্গে ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকের সঙ্গে সম্পর্কিত নির্মাণকাজে বিদেশি শ্রমিকের প্রয়োজন জাপানের হবে। তবে সেই বাজারের সম্ভাবনা খুঁজে দেখার সবচেয়ে সহজ পথ হচ্ছে জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তির কাঠামোয় ঢুকতে পারা। অর্থনৈতিক অংশীদারি চুক্তি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য আলোচনার সূত্রপাত করতে পারলে সেটি বড় এক ধাপ অগ্রগতিরই ইঙ্গিত৷ সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত হবে এ ব্যাপারে জাপানকে উৎসাহ জোগানো।
জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যকার সাংস্কৃতিক যোগাযোগ দীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত থাকার পর গত বছর সেতো-উচি উৎসবে যোগদানের মধ্য দিয়ে গতি সঞ্চারিত হয়। সেই ধারাকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশকে উদ্যোগ নিতে পারে।
প্রধানমন্ত্রীর বর্তমান জাপান সফর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করবে। তবে সেসব সুযোগ আমরা কতটা কাজে লাগাতে পারব, তা কিন্তু অনেকাংশেই নির্ভর করবে আমাদের নিজেদের দক্ষতা আর বিচারবুদ্ধির ওপর। কূটনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষাকৃত কঠিন এই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের ব্যবস্থা করতে পারা অবশ্যই হচ্ছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাপানে
বাংলাদেশ দূতাবাসের সম্মিলিত সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। আশা করি, একই ধারার সুফল আমরা আগামী দিনগুলোতেও পাব।
টোকিও থেকে
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক৷