হিচককের বাড়ি

মানুষের মতোই কোনো একটা স্থান বিশেষ স্থান হয়ে ওঠে প্রথমত তার অবয়ব সংস্থানের কারণেই। আবহাওয়ার কারণে তার শারীরিক ভূগোলটা, তার সৌন্দর্যটা মানুষকে টানে। আর তার সঙ্গে যদি যুক্ত হয় মানুষের অসাধারণ কর্মকাণ্ড, তবে সেই স্থানই হয়ে ওঠে তীর্থ। রবীন্দ্র, নজরুল, রোকেয়া, মাইকেল, দেশে যেখানে জন্মেছিলেন বা কর্মে ছিলেন, সেখানে পা দিলেই যেন ইতিহাস লাফিয়ে ওঠে। এ দেশে শেক্সপিয়ার, বায়রন, বিটলসগণ যেখানে যে বাড়িতে বাস করেছিলেন বা জন্ম নিয়েছিলেন, সে জায়গায় গেলে তেমনি কী যেন গ্রাস করে। 
ওয়ানস্টেড ভিলিজ কনসারভেশন এলাকাতেই এখন আমার বসবাস। অনেক অনেক আগে এ স্থানটি যখন গ্রাম ছিল, তা থেকে এখনো একে খুব আলাদা করা যায় না। এর বর্ধিত অঞ্চল এক কালের বৃহত্তর এসেক্স ছিল। জায়গাটা ভীষণ অরগানিক আর থেরাপিউটিক। আমার একদিকে লেইটোনস্টোন আরেক দিকে উডফোর্ড গ্রিন। একদিন হালকা তুষারে ভারী কোট পরে হাঁটছি, বহু পুরোনো হুইপ্সক্রস হাসপাতালের দিকের রাস্তাটা ধরে। বৃক্ষের মতো বিশাল ক্যাকটাসের কাঁটায় কাঁটায় চিনির মতো বরফ বসে আছে। রাস্তার উল্টো দিকে বিশাল এক ভিক্টোরিয়া আমলের টেরেস্ট ভুতুড়ে দালানের মতো এক হোটেল। নাম স্যার অ্যালফ্রেড হিচকক হোটেল! প্রবল আগ্রহে আমাদের জমিদারবাড়িগুলোর মতো বিস্তৃত সিঁড়িগুলো বেয়ে ওপরে উঠে আমি তাজ্জব!
এটি খোলা হয়েছে হিচককের জন্ম মাস আগস্টেই, কিন্তু ১৯৮৮ সালে। ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায় না এ কোন সময়। এখানে-ওখানে বিখ্যাত সেই ব্রিটিশ চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি তারকা চিত্রনির্মাতা হিচককের ছবি, পেপার কাটিং, পুরোনো টুন টুকরা আরও কত কী! ব্যাপার আসলে আর কিছু না, ব্যবসা। ওর নাম শুনেই লোকে এখানে ওঠে। কিন্তু কারণ একটা আছে, এখান থেকে ঢিল মারলে ওই লেইটোনস্টোনে তার যে বাড়িতে জন্ম হয়েছে, সেখানে গিয়ে পড়বে!
বাড়ি এসেই গুগল সাহেবকে নিয়ে পড়ি আর সার্চ করে অনেক মজার মজার তথ্য পেয়ে যাই। কী কাণ্ড, এ তো দেখি ব্রিটিশ মহাজ্ঞানী মহাজনদের এলাকা। এই এলাকায় শুধু অদ্ভুতুড়ে ছবি নির্মাতা স্যার আলফ্রেড জোসেফ হিচকক নয়, ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সমরমন্ত্রী বিলেতের অন্যতম প্রধানমন্ত্রী স্যার উইন্সস্টোন চার্চিল এবং মেয়েদের ভোটাধিকার লড়াইয়ের পুরোধা মহাত্মা গান্ধীর সান্নিধ্যে আসা ইস্ট অ্যান্ডের প্যাঙ্ক্রাস্ট ভগিনীদ্বয়ের একজন অ্যামিলিও এদিকেই ছিলেন। চার্চিল আর প্যাঙ্ক্রাস্ট থাকতেন উডফোর্ড গ্রিনের দিকে সাউথ উডফোর্ডে। তবে আমার সবচেয়ে কাছে হিচককের বাড়ি। যেখানে ১৮৯৯ সালের ১৩ আগস্ট ৫১৭ হাই রোড লেইটোনস্টোন স্থানীয় সবজি বিক্রেতা উইলিয়াম ও এমা হিচককের ঘরে তাঁর জন্ম হয়।
কম্পিউটার রেখে গাড়ি ছাড়লাম লেইটোনস্টোনের দিকে। গ্রিনম্যান রাউন্ড অ্যাবাউট ঘুরতে ওপর দিকে বিচ্ছিরি শব্দ দিয়ে চারটা সিগ্যাল উড়ে গেল। আমার মাথায় তখন হিচককের বার্ড ছবির পাখিদের ঠোকরের কথা মনে হলো। পেরিয়ে যাচ্ছি পাউন্ড শপ, প্রাইমার্ক, আমার চুল কাটার পোলিশ দোকান। কিছুই নেই আর আগের মতো। শুনেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইস্ট অ্যান্ডে যেসব জায়গায় বোমা পড়েছে, এ জায়গা তার একটি।
আমি নম্বর ধরে ধরে এগিয়ে যাই। ৫১৫ আছে কিন্তু সেই বাড়ি নেই! সে জায়গায় দাঁড়িয়ে অতি সাধারণ কী এক পেট্রলপাম্প, তার নাম জেট। সেখানে লাইন দিয়ে গাড়িতে তেল ভরা হচ্ছে। আমি একটু থতমত করে ঢুকলাম। কজন নব্য ইমিগ্রান্ট পোলিশ নিজস্ব ভাষা বলছে আর মহা উৎসাহে যারা গাড়ি ধুতে চায়, জেট দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে। আমার তো পেট্রলের দরকার না। আমি গাড়ি ধোয়ার লাইন দিলাম। ভাবলাম গাড়িটা পোলিশের হাতে ঘষাঘষির জন্য দিয়ে পাম্পের লোকের কাছে ইনফরমেশন জানতে চাইব।
গাড়িটা জুত করে রেখে নিজেই দেখি ওদের লাল দেয়ালে চকচক করছে ইংলিশ হেরিটেজের ব্লু প্লাক। এ দেশে গুণীজনের বসবাসের স্থানগুলো চিহ্নিত করে রাখার জন্য ১৮৬৩ সালে এম পি উইলিয়াম এওয়ার্ট মেমোরিয়াল ট্যাবলেটের মতো একটা উদ্যোগের প্রস্তাব রাখেন। ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের উদ্যোগে ১৮৬৭ সালে এর প্রথমটা লাগানো হয় বিখ্যাত ইংলিশ কবি লর্ড বায়রনের স্মরণে। তত দিনে কবি গত হয়েছেন প্রায় ১০০ বছর। তারপর একে একে এতগুলো বছর ইংল্যান্ডে কাজ করে বা জন্ম নিয়ে যিনিই বিশ্বমানের খ্যাতি এনেছেন, তাঁদের বাড়ি বা কাজের জায়গাগুলো চিহ্নিত করে রেখেছে ইংলিশ হেরিটেজ। শুধু লন্ডনেই ব্লু প্লাক আছে প্রায় ৯০০। জিনিসটা দেখতে উপুড় করা গোলাকার ধাতব সরার মতো। প্রথম দিকে এটি নানা রঙে হতো আর ছবিও থাকত। পরে ক্রমেই ব্যয় সংকোচ করে শুধু রুপালি অক্ষরে বরণীয় সেই মানুষটির নাম ও ছোট্ট কয়েক শব্দে তার পরিচয় লেখা হতো। রং নীল।
আমি তেলাধারের কাছে কফি কিনে লেখা দেখি। বোমা পড়েছিল বলে সেই দালানগুলো নেই। সময়ের পরিবর্তনে এখন এমন সব নতুন কিছু হয়ে গেছে, যার সঙ্গে সেই মহর্ষির যোগসূত্র খুঁজে পাওয়াই কঠিন। ত্রয়োদশ শতাব্দীর সময় এ পুরো জায়গাটিই এসেক্সের বনাঞ্চল ছিল। ঘোড়া দৌড়িয়ে গুলি করে খ্যাঁকশিয়াল হত্যা করাই ছিল এক মজার খেলা। ক্রমে ক্রমে নগরায়ণ হয়েছে। ভাগাভাগির জায়গার পৌরহিত্য বর্তেছে নানা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকের হাতে। সুরত বদলেছে স্থানীয় জনগণের আগ্রহে, কিন্তু সরকারের ইচ্ছায়। একসময় চার্চিল হয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। আর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে উচ্চারণ করেছিলেন, গিভ আস দি টুলস অ্যান্ড উই উইল ফিনিশ দ্য জব! সিলি্ভয়ার বোন এমিলি বসবাস করে গেছেন জীবনের শেষ ২৫ বছর।
আর কে জানে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে গাড়ি ধোয়াচ্ছি, কফি খাচ্ছি, এখানেই তার বাড়িতে হয়তো গভীর রাতে যুবক হিচকক সিগ্যালের চিৎকারে ঘুম ভেঙে মনে মনে নির্মাণ করেছিলেন তাঁর অদ্ভুতুড়ে ছবিগুলো।
শামীম আজাদ: কবি ও কলামিস্ট।