হূদেরাগ প্রতিরোধে সচেতনতা

হূদেরাগ প্রতিরোধে সচেতনতা
হূদেরাগ প্রতিরোধে সচেতনতা

বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে হূদেরাগ বিশ্বের এক নম্বর মরণব্যাধি। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১০ জনে একজনের হূদেরাগের সমস্যা রয়েছে। কোনো রকমের পূর্বাভাস ছাড়াই এ রোগ কেড়ে নিতে পারে আপনার জীবন। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হূদেরাগের প্রবণতা বেড়ে যায়। যদিও উন্নত বিশ্বে হূদেরাগজনিত মৃত্যুর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের দেশগুলোতে হূদেরাগজনিত মৃত্যু দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। হার্ট অ্যাটাক, অ্যানজাইনা, উচ্চ রক্তচাপ, এথারোস্ক্লেরোসিসসহ বিভিন্ন ধরনের হূদেরাগের আশঙ্কা রয়েছে। অ্যানজাইনা হলে হূৎপিণ্ডের স্থায়ী ক্ষতি হয় না—অক্সিজেনের অভাব হয় ক্ষণস্থায়ী। বিশ্রাম নিলে বা ওষুধ খেলে ব্যথা কমে যায়। কিন্তু হার্ট অ্যাটাক হলে অক্সিজেনের অভাব হয় অনেক সময়ের জন্য। ওষুধ বা বিশ্রামে ব্যথার উপশম খুব একটা হয় না। হূৎপিণ্ডের ক্ষতি হয় স্থায়ীভাবে। হার্ট অ্যাটাকের মূল কারণ হলো এথারোস্ক্লেরোসিস। অতিরিক্ত ধূমপান, শুয়ে-বসে সময় কাটানো, শরীরচর্চাহীন জীবন, চর্বিযুক্ত খাবারের ফলে ধমনিগাত্রে চর্বি, কোলেস্টেরল এবং অন্যান্য জৈব পদার্থ মোমের মতো জমা হতে থাকে, যাকে বলা হয় ‘প্লেক’। মোমের মতো চর্বি ধমনিগাত্রে জমা হওয়ায় ধমনিগুলো সরু হতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক নাম এথেরোস্ক্লেরোসিস। সরু ধমনিতে রক্তের ক্লট ধমনিপথকে পুরোপুরি বন্ধ করে দিলেই ঘটে হার্ট অ্যাটাক।
১. উচ্চ রক্তচাপের ফলেও হার্টসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় শতকরা ২০ ভাগ প্রাপ্ত বয়স্ক এবং শতকরা ৪০-৬৫ ভাগ বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপে ভুগে থাকেন। এ সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সিস্টলিক এবং ডায়াস্টলিক রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি. মারকারির চেয়ে বেশি হলেই আমরা উচ্চ রক্তচাপ বলে থাকি। হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ এমন একটি অসুখ, যা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হতে পারে। কোনো কিছু বোঝার আগেই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো অপ্রত্যাশিত পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এ জন্য উচ্চ রক্তচাপকে অনেক সময় ‘নীরব ঘাতক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।
২. ব্যায়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ব্যায়াম কেবল রক্তচাপই কমায় না, উপকারী কোলেস্টেরল এইচডিএলের পরিমাণ বাড়ায়, ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএলের পরিমাণ কমায়, ওজন কমায়, মানসিক চাপ দূর করতে সহায়তা করে এবং হূদেরাগের ঝুঁকি কমায়। রসুন, কলমিশাক, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, শসা, গোলাপজাম, আপেল, কমলা, কলা, আনারস ইত্যাদি রক্তচাপ কমাতে সহায়তা করে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত ওষুধ ব্যবহার একেবারেই সমীচীন নয়। সব ওষুধ সবার ক্ষেত্রে একভাবে কাজ করে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত নিজে নিজে চিকিৎসার পথ বেছে নিলে বিপদ হতে পারে।
৩. নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাস আমাদের বিভিন্ন ধরনের হূদেরাগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। কম চর্বিযুক্ত খাবার খেলে ১৫% থেকে ৩৭% কোলেস্টেরল কমানো সম্ভব হতে পারে। চিংড়ি, গরুর মাংস, মহিষের মাংস, ছাগলের মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য ক্ষতিকর এলডিএল পরিমাণ বাড়ায়। প্রচুর পরিমাণ আঁশযুক্ত খাবার ও বাদামজাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে রক্তে উপকারী এইচডিএল বাড়ানো সম্ভব। বেশি করে শাকসবজি ও মৌসুমি ফল খাওয়া বাঞ্ছনীয়।
৪. ধূমপান, টেনশন ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপ বাড়ানোর নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এ ক্ষেত্রে ধূমপান পরিত্যাগ করা অত্যাবশ্যক। টেনশন উচ্চ রক্তচাপ ছাড়াও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের জন্মদাতা। তাই টেনশন পরিহার করুন। সবশেষে বলব, হাসুন, বেশি করে হাসুন। একটু হাসিখুশি, দুশ্চিন্তামুক্ত ও উচ্ছ্বসিত থাকলে অনেক রোগ থেকেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। হাসিতে রয়েছে হরেক রকমের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক উপকারিতা এবং পুরো ব্যাপারটির রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। কর্টিসল, এডরিনালিন, ডোপামিন, গ্রোথ হরমোনের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে মানসিক চাপ, অশান্তি ও যেকোনো কষ্টকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হাসি সহযোগিতা করে, শরীরে রক্তের প্রবাহ ও অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়িয়ে রক্তের চাপ কমায়, ফলে অনেক রকমের হূদেরাগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় সহজেই।
হূদেরাগ বর্তমানে আমাদের দেশের বড় সমস্যা। সুস্থ দেহ ও সুস্থ মন বিকাশে এবং হূদেরাগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন নিজে সচেতন হওয়া ও অপরকে সচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করা।
ড. আবুল হাসনাত: অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]